বাংলাদেশের ট্রাফিক আইন ও ব্যবস্থার বিশ্লেষণ

বাংলাদেশের ট্রাফিক শৃঙ্খলা ও সড়ক নিরাপত্তা: বিদ্যমান আইন, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা এবং নীতিগত সংস্কারের রোডম্যাপ

(প্রতিবেদক: জে এইচ সুমন, জনতা নিউজ)

প্রতিবেদন সারসংক্ষেপ ও প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ

১.১ ভূমিকা: বাংলাদেশের পরিবহন ব্যবস্থার অর্থনৈতিক ও সামাজিক গুরুত্ব

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং সামাজিক সচলতার জন্য সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা একটি মেরুদণ্ডস্বরূপ। তবে, বর্তমানে এই ব্যবস্থাটি গভীর অব্যবস্থাপনা, ভয়াবহ যানজট এবং চরম সড়ক নিরাপত্তা ঝুঁকির সম্মুখীন। সড়ক পথের এই বিশৃঙ্খলা কেবল নাগরিকের মূল্যবান সময় অপচয় করছে না, বরং জাতীয় অর্থনীতিতে বিশাল নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে এবং পরিবেশের ওপর বিরূপ চাপ সৃষ্টি করছে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য বিদ্যমান আইন, প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো এবং তার প্রয়োগের কার্যকারিতা বিশ্লেষণ করে একটি সুসংহত ও নীতি-ভিত্তিক সমাধান রোডম্যাপ তৈরি করা জরুরি। এই প্রতিবেদনটি বিশেষত সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮-এর কার্যকারিতা, আইন প্রয়োগে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা এবং বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের জন্য প্রয়োজনীয় সুদূরপ্রসারী নীতিগত সংস্কারের পথচিত্র বিশদভাবে তুলে ধরবে।

১.২ সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮: একটি সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা

নিরাপদ সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা নিশ্চিতকল্পে এবং সময়ের চাহিদা প্রতিফলনে Motor Vehicles Ordinance, 1983 রহিত করে নতুন করে সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮ প্রণয়ন করা হয়। এই আইনটি ২০১৯ সালের ১ নভেম্বর থেকে কার্যকর হয় এবং এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল মোটরযান রেজিস্ট্রেশন, ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদান, রুট পারমিট এবং আইন লঙ্ঘনের শাস্তির বিধানকে যুগোপযোগী করা। এই আইন বহুলাংশে কঠোরতা আরোপ করেছে।

আইনের মূল প্রশাসনিক দিকগুলির মধ্যে রয়েছে মোটরযানের রেজিস্ট্রেশন সনদ প্রদান, যেখানে লিজ বা কিস্তিতে মূল্য পরিশোধের চুক্তির মাধ্যমে ক্রয়কৃত গাড়ির ক্ষেত্রে সেই চুক্তি সংক্রান্ত তথ্যাদি সনদে লিপিবদ্ধ করার বিশেষ বিধান রাখা হয়। এছাড়া, ফিটনেস সনদ ব্যতীত, মেয়াদ উত্তীর্ণ বা ফিটনেসের অনুপযোগী, ঝুঁকিপূর্ণ অথবা পরিবেশ দূষণকারী মোটরযান চালনা বা চালনার অনুমতি প্রদান সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এই ধারাগুলো কঠোরভাবে প্রয়োগের মাধ্যমে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়েছে।

১.৩ ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার মূল চ্যালেঞ্জসমূহ: আইন প্রয়োগের দুর্বলতা থেকে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি

আইনের কঠোরতা সত্ত্বেও, ট্রাফিক শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি হয়নি। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগ নিয়মিত অভিযান চালিয়ে ট্রাফিক আইন লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে বিপুল সংখ্যক মামলা দায়ের করছে। যেমন, একটি উদাহরণস্বরূপ দেখা যায়, অক্টোবর ২০২৫ সালের এক দিনে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ১ হাজার ২৪৩টি মামলা দায়ের করা হয়, এবং ৩০৯টি গাড়ি ডাম্পিং ও ৯৩টি রেকার করা হয়।

তবে, এই বিপুল সংখ্যক আইন প্রয়োগ ও মামলা দায়েরের পরও সামগ্রিক ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই বলে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী নিজেই স্বীকার করেছেন। তিনি এই অচলাবস্থার জন্য দুটি প্রধান কারণ চিহ্নিত করেছেন: প্রথমত, সড়ক ব্যবহারকারীদের ব্যাপক অসচেতনতা (যেমন, ১০০ মিটার দূরে পদচারী-সেতু থাকা সত্ত্বেও রাস্তা পার হওয়া) এবং দ্বিতীয়ত, সিটি করপোরেশনের রাস্তা তদারকির দায়িত্বে থাকা বিভাগের উদাসীনতা। এই বিশ্লেষণ স্পষ্ট করে যে সমস্যাটি কেবল আইন প্রয়োগের অভাব নয়; বরং এটি আইন মানার মানসিকতা এবং কাঠামোগত সমন্বয়হীনতার ফসল।

আইনগত কঠোরতার পাশাপাশি, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা বিশেষ করে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)-এর অভ্যন্তরে বিরাজমান দুর্নীতি এবং নগর কর্তৃপক্ষ ও ট্রাফিক পুলিশিং-এর মধ্যে সমন্বয়হীনতা এই সমস্যার মূল কারণ হিসেবে কাজ করছে।

সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮: প্রয়োগ ও সীমাবদ্ধতা

২.১ আইনের মূল কাঠামো ও প্রশাসনিক প্রক্রিয়া

সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮-এর দ্বিতীয় অধ্যায় মোটরযান রেজিস্ট্রেশন সংক্রান্ত বিধান নিয়ে আলোচনা করে। এই আইন অনুযায়ী, কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রদত্ত রেজিস্ট্রেশন সনদ ছাড়া কোনো মোটরযান চালানো যায় না। বিশেষ বিধান অনুযায়ী, লীজ বা কিস্তিতে ক্রয়কৃত মোটরযানের ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ রেজিস্ট্রেশন সনদে চুক্তি সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদি লিপিবদ্ধ করে। মালিকানা পরিবর্তনের ক্ষেত্রে, হস্তান্তরগ্রহীতাকে হস্তান্তরের ৬০ দিনের মধ্যে নিজের নামে রেজিস্ট্রেশনের জন্য কর্তৃপক্ষের নিকট আবেদন করতে হয় এবং কর্তৃপক্ষ সাধারণত ৩০ দিনের মধ্যে যাবতীয় কার্যক্রম সম্পন্ন করে।

এছাড়াও, মোটরযানের ফিটনেস সনদ, ট্যাক্স টোকেন এবং রুট পারমিট সংক্রান্ত কঠোর শর্ত রয়েছে। মেয়াদ উত্তীর্ণ ফিটনেস সনদ বা ইকোনোমিক লাইফ অতিক্রান্ত ফিটনেসের অনুপযোগী মোটরযান চালনা বা চালনার অনুমতি প্রদান সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কোনো মোটরযানের রেজিস্ট্রেশন সংক্রান্ত শর্তাবলি ভঙ্গ করলে, কর্তৃপক্ষ শুনানি গ্রহণ ও কারণ লিপিবদ্ধ করে রেজিস্ট্রেশন স্থগিত বা বাতিল করতে পারে। আইনটি একটি যুগোপযোগী ও শক্তিশালী আইনি ভিত্তি তৈরি করলেও, এর প্রয়োগে কাঠামোগত দুর্বলতা প্রকট।

২.২ আইন লঙ্ঘনের দণ্ডবিধি বিশ্লেষণ: জরিমানা ও শাস্তির তুলনামূলক পর্যালোচনা

সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮-এর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো এটি পূর্ববর্তী Motor Vehicles Ordinance, 1983-এর তুলনায় শাস্তির বিধানকে বহুলাংশে কঠোর করেছে। এটি ছিল সড়ক নিরাপত্তার পক্ষে জনদাবির প্রতিফলন।

গুরুত্বপূর্ণ আইন লঙ্ঘনের জন্য ধার্য করা কতিপয় দণ্ডবিধি নিচে একটি সারণীতে তুলে ধরা হলো:

সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮-এর কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ অপরাধ ও দণ্ডবিধি

ধারা নং অপরাধের ধরণ ন্যূনতম/সর্বোচ্চ দণ্ড দোষসূচক পয়েন্ট কর্তন তথ্যসূত্র
৬৬ ড্রাইভিং লাইসেন্স ব্যতীত মোটরযান চালনা অনধিক ৬ মাস কারাদণ্ড বা অনধিক ২৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড প্রযোজ্য নয় 7
৭২ রেজিস্ট্রেশন ব্যতীত মোটরযান চালনা অনধিক ৬ মাস কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড প্রযোজ্য নয় 7
৭৫ ফিটনেস সনদ ব্যতীত বা অনুপযোগী যান চালনা অনধিক ৬ মাস কারাদণ্ড বা অনধিক ২৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড প্রযোজ্য নয় 7
৮৭ নির্ধারিত গতিসীমার অতিরিক্ত গতিতে/বেপরোয়াভাবে চালনা অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা অনধিক ৩ মাস কারাদণ্ড বা উভয় দণ্ড ১ পয়েন্ট 7
৯০ অননুমোদিত ওভারটেকিং বা চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা অনধিক ৩ মাস কারাদণ্ড বা উভয় দণ্ড ১ পয়েন্ট 7
৯২ হেলমেট ব্যবহার না করা (চালক ও সহযাত্রী) অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা অনধিক ৩ মাস কারাদণ্ড বা উভয় দণ্ড প্রযোজ্য নয় 7

এই সারণী থেকে স্পষ্ট যে আইনটিতে যথেষ্ট কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ড্রাইভিং লাইসেন্স ব্যতীত মোটরযান চালনার জন্য অনধিক ২৫ হাজার টাকা জরিমানা এবং/অথবা ৬ মাসের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। এমনকি বেপরোয়া চালনার ক্ষেত্রে অর্থদণ্ডের পাশাপাশি চালকের দোষসূচক পয়েন্ট কর্তনের বিধানও রাখা হয়েছে, যা আধুনিক ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

তবে, কঠোর শাস্তির বিধান থাকা সত্ত্বেও ট্রাফিক বিশৃঙ্খলার মৌলিক পরিবর্তন না হওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত প্রশ্ন তৈরি করে। ঢাকাতে দৈনিক হাজারের উপর মামলা দায়ের হচ্ছে, কিন্তু ডিএমপি কমিশনারের মতে, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় কোনো অগ্রগতি নেই। এটি ইঙ্গিত দেয় যে, শাস্তির পরিমাণ বৃদ্ধি বা প্রয়োগের সংখ্যা বাড়ানো হলেও, তা জনস্বার্থ বা ট্রাফিক শৃঙ্খলার ওপর মৌলিক প্রভাব ফেলছে না। কারণ, সড়কে বিশৃঙ্খলার মূল কারণ আইন প্রয়োগের অভাব নয়, বরং কাঠামোগত দুর্বলতা এবং আইন মানার মানসিকতার অভাব, যা সিটি করপোরেশনের উদাসীনতা এবং নাগরিক অসচেতনতার ফল।

২.৩ আইনি সীমাবদ্ধতা: সড়ক হত্যাকাণ্ডের সংজ্ঞা ও শাস্তির বিতর্ক

সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮-এর অন্যতম কেন্দ্রীয় বিতর্কিত ধারা হলো ১০৫, যা সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর জন্য দণ্ডের বিধান করে। সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে দীর্ঘদিন ধরে এই ধারা সংশোধন করে সড়ক দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর ক্ষেত্রে এটিকে ‘সড়ক দুর্ঘটনা’ না বলে ‘সড়ক হত্যাকাণ্ড’ হিসেবে গণ্য করার দাবি উঠেছে। তারা দণ্ডবিধির (Penal Code) ধারা ৩০২ পুনঃস্থাপন করার দাবি জানিয়েছেন, যাতে বেপরোয়া চালনায় মৃত্যুর জন্য মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রাখা যায়।

এই দাবির মূল উদ্দেশ্য হলো, যদি কোনো চালকের চরম অবহেলা বা বেপরোয়া মনোভাবের কারণে মানুষের মৃত্যু হয়, তবে এটিকে নিছক দুর্ঘটনা হিসেবে বিবেচনা না করে অপরাধ হিসেবে বিচার করা। এছাড়াও, এই আইনের কঠোরতা কার্যকর হওয়ার সাথে সাথে চলমান সকল মামলা এই নতুন, কঠোর আইনে বিচার করার দাবি রয়েছে।

এই আইনি দুর্বলতার গভীরতা অনুধাবন করা যায় পথচারী সুরক্ষা সংক্রান্ত প্রশ্ন থেকে। যদি পথচারী জেব্রা ক্রসিং দিয়ে আইন মেনে পার হওয়ার সময়ও গাড়ির চাপায় হত্যাকাণ্ডের শিকার হয় এবং ঘাতক চালকের কঠোর সাজার বিধান না থাকে, তবে পথচারী কেন আইন মানবে? আইন যদি পথচারী সুরক্ষায় পর্যাপ্ত শক্তিশালী না হয়, তবে কেবল পথচারীকে আইন লঙ্ঘনের জন্য জরিমানা করার নৈতিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে।

এছাড়াও, আইনি কাঠামোতে মালিকের দায়বদ্ধতা এড়ানোর সুযোগ থাকায় অদক্ষ চালক নিয়োগ উৎসাহিত হয়। নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে যে যদি ঘাতক চালককে গ্রেপ্তার করা না যায়, তবে পরিবহন মালিককেই সাজার আওতায় আনতে হবে। ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন ব্যবহার করে পথচারীর হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার ক্ষেত্রেও মালিককে শাস্তির আওতায় আনার বিধান থাকা জরুরি। এই বিধানগুলোর অভাবই নির্দেশ করে যে RTA 2018 যথেষ্ট কঠোর হলেও, মালিক পক্ষের অর্থনৈতিক দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এতে গুরুত্বপূর্ণ দুর্বলতা রয়েছে।

ট্রাফিক ব্যবস্থার অপারেশনাল ব্যর্থতা এবং প্রাতিষ্ঠানিক চ্যালেঞ্জ

৩.১ সড়ক দুর্ঘটনার ভয়াবহতা ও উপাত্তে বিভ্রান্তি

বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা এবং এর ভয়াবহতা একটি জাতীয় উদ্বেগ। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)-এর সেপ্টেম্বর ২০২৫ মাসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সারাদেশে ৪৩৫টি সড়ক দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়, যার ফলে ৪০৯ জন নিহত এবং ৪০০ জন আহত হন।

সেপ্টেম্বর ২০২৫ মাসে সড়ক দুর্ঘটনার চিত্র (বিআরটিএ অনুসারে)

বিভাগ দুর্ঘটনার সংখ্যা নিহত সংখ্যা আহত সংখ্যা তথ্যসূত্র
ঢাকা ১০৩ ৭৭ ১১০ 9
চট্টগ্রাম ৮৪ ৭৪ ৮৭ 9
রাজশাহী ৬৪ ৬৩ ৪৯ 9
খুলনা ৩৬ ৩২ ৩১ 9
বরিশাল ২৪ ৩৩ ২১ 9
সিলেট ২৫ ২৩ ২১ 9
রংপুর ৪০ ৩৭ ২৬ 9
ময়মনসিংহ ২৩ ৩৬ ২২ 9
মোট ৪৩৫ ৪০৯ ৪০০ 9

এই পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের মধ্যে মোটরযান ভিত্তিক ঝুঁকিতে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে মোটরসাইকেল। সেপ্টেম্বরে মোট নিহত ৪০৯ জনের মধ্যে প্রায় ২৯.৮৩% (১২২ জন) নিহত হন মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায়। এছাড়া, ট্রাক/কাভার্ডভ্যান দুর্ঘটনায় নিহত হন ১৫.৪০% (৬৩ জন)। এই উপাত্ত স্পষ্টতই মোটরসাইকেল চালকদের জন্য বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং বাণিজ্যিক যানবাহনের নজরদারি কঠোর করার প্রয়োজনীয়তা নির্দেশ করে।

তবে, সড়ক দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান নিয়ে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার মধ্যে ব্যাপক বিভ্রান্তি বিদ্যমান। চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের সংগঠন ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ (নিসচা) এই বিভ্রান্তির কারণে ২০২৩ সাল থেকে তাদের বার্ষিক পরিসংখ্যান প্রকাশ না করার সিদ্ধান্ত নেয়। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৫ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) রিপোর্টে বাংলাদেশে ২১ হাজার ৩১৬ জনের মৃত্যুর কথা বলা হলেও, পুলিশের রিপোর্টে মাত্র ২ হাজার ৩৭৬ জনের মৃত্যুর উল্লেখ ছিল। এই পরিসংখ্যানগত বিভ্রান্তি নীতি প্রণয়নের জন্য প্রয়োজনীয় প্রমাণ-ভিত্তিক (Evidence-Based) তথ্যের চরম অভাবকে নির্দেশ করে, যা কার্যকর সমাধান গ্রহণকে বাধাগ্রস্ত করে।

৩.২ ইন্টেলিজেন্ট ট্রাফিক সিস্টেম (ITS)-এর ব্যর্থতা: অপচয় ও সমন্বয়হীনতা

ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় প্রযুক্তিগত উন্নয়নের উদ্যোগগুলো ধারাবাহিকভাবে ব্যর্থ হয়েছে। গত প্রায় দুই দশকে ট্রাফিক সিগন্যাল ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ বাস্তবায়নে সরকারের ৩০০ কোটি টাকার বেশি অপচয় হয়েছে (৩টি প্রকল্পে ১৮২ কোটি এবং এক দশকে বিদ্যুৎ বিল বাবদ ১২০ কোটি টাকা)।

২০০৪ সাল থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময়ে স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল ব্যবস্থা এবং ইন্টেলিজেন্ট ট্রাফিক সিস্টেম (ITS) প্রযুক্তি স্থাপন করা হলেও গুলশান-২ ব্যতীত রাজধানীর প্রায় সব ইন্টারসেকশনে এখনো ট্রাফিক পুলিশ হাতের ইশারায় যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করে 11। পরিকল্পনা কমিশনের এক প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে এই পদ্ধতি কোনো কাজেই আসেনি এবং এই খাতে ব্যয় হওয়া অর্থ পুরোটা অপচয় হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই ব্যর্থতার মূল কারণ প্রযুক্তিগত ত্রুটি বা তহবিলের অভাব নয়, বরং ‘সমন্বয়ের অভাব’ এবং ‘নগর পরিকল্পনার দুর্বলতা’। ঢাকার সড়কে কম গতি ও বেশি গতির পরিবহণের বিশৃঙ্খল সহাবস্থান এবং সিটি করপোরেশন ও ট্রাফিক পুলিশের মধ্যে ব্যবস্থাপনায় সমন্বয়ের অভাবে প্রতিটি প্রযুক্তিগত প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়েছে। যদি ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার পুরো দায়িত্ব একটি একক, প্রযুক্তি-সক্ষম সংস্থাকে (যেমন পুলিশ) দেওয়া না হয় এবং শহরের মিশ্র ট্রাফিকের প্রকৃতি বিবেচনা করে বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতি অনুসরণ করা না হয়, তবে ভবিষ্যতে আরও শত শত কোটি টাকা খরচ করেও এই সমস্যা সমাধান করা অসম্ভব হবে।

৩.৩ প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা: বিআরটিএতে দুর্নীতি ও দালাল চক্রের প্রভাব

সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম প্রধান কারণ হলো অদক্ষ ও লাইসেন্সবিহীন চালক। এই অদক্ষ চালক তৈরির নেপথ্যে কাজ করছে বিআরটিএ-এর অভ্যন্তরে বিদ্যমান প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি এবং দালাল চক্রের প্রভাব। রাজবাড়ী কার্যালয়ের মতো বিআরটিএ-এর বিভিন্ন কার্যালয় ঘুষ ও দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সেখানে দালাল ছাড়া সেবাগ্রহীতাদের কোনো কাজ হয় না।

যদিও ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে শিক্ষানবিশ লাইসেন্স, লিখিত, মৌখিক এবং ফিল্ড টেস্টসহ একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার বিধান রয়েছে, কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে দালালদের মাধ্যমে চাহিদামতো অর্থের বিনিময়ে (যেমন: লাইসেন্স পেতে সাড়ে আট হাজার টাকা বা ভারী থেকে হালকা লাইসেন্স করার জন্য ৬ হাজার টাকা) সহজে কাজ করিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়। এমনকি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অভিযান চালিয়ে দালাল চক্রকে গ্রেপ্তার করার পরও তারা জামিনে মুক্তি পেয়ে পুনরায় তাদের কার্যক্রম শুরু করেছে।

এই প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি সরাসরি সড়কে নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। বিআরটিএ হলো মোটরযানের রেজিস্ট্রেশন এবং চালকের যোগ্যতা যাচাইয়ের প্রাথমিক নিরাপত্তা গেটওয়ে। যদি এই গেটওয়ে দুর্নীতির মাধ্যমে দুর্বল হয়ে পড়ে, তবে আইন যতই কঠোর হোক না কেন, সড়কে অদক্ষ চালকের সংখ্যা বাড়তেই থাকবে, এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে অনবরত মামলা করে গেলেও পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য তাই এই প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি নির্মূল করা অপরিহার্য।

আদর্শ আইন কাঠামো: বিশেষজ্ঞ ও সুশীল সমাজের প্রস্তাবনা

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটি আদর্শ ট্রাফিক আইন কেমন হওয়া উচিত, সে বিষয়ে নীতি বিশ্লেষক এবং সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮-এর সংশোধনের প্রস্তাবিত খসড়ায় বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ দাবি উত্থাপন করা হয়। এই প্রস্তাবনাগুলো কেবল শাস্তির কঠোরতা বৃদ্ধি নয়, বরং আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার দিকে মনোনিবেশ করে।

৪.১ সড়ক হত্যাকে আইনি দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়ন: ফৌজদারি ধারার পুনঃপ্রবর্তন

আইনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবনাগুলির মধ্যে একটি ছিল সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮-এর ধারা ১০৫ (যা দুর্ঘটনায় মৃত্যুর জন্য দণ্ডের বিধান করে) সংশোধন করে ফৌজদারি দণ্ডবিধির (Penal Code) ধারা ৩০২ পুনঃস্থাপন করা। এই পরিবর্তন কার্যকর হলে বেপরোয়া চালনায় মৃত্যুর ক্ষেত্রে অপরাধী চালকের জন্য মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রাখা সম্ভব হতো। এই দাবির মূল উদ্দেশ্য ছিল সড়ক দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুকে আইনিভাবে হত্যাকাণ্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা।

এছাড়াও, এই সংস্কার প্রস্তাবের মধ্যে পুলিশ প্রশাসনের জবাবদিহিতার বিষয়টিও উঠে আসে। সড়ক হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রে ঘাতক চালককে ৭ দিনের মধ্যে গ্রেপ্তার করতে না পারলে পুলিশ প্রশাসনকে জবাবদিহি করতে হবে বলে দাবি জানানো হয়। এই দাবিটি প্রমাণ করে যে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য কেবল কঠোর শাস্তিই যথেষ্ট নয়, বরং তদন্তকারী সংস্থার দ্রুততা ও স্বচ্ছতার নিশ্চয়তাও প্রয়োজন।

৪.২ পরিবহন মালিকদের দায়বদ্ধতা নিশ্চিতকরণ

সড়ক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে পরিবহন মালিকদের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় নীতিগত সংস্কার। সুশীল সমাজ দাবি করেছে যে, আইনকে অবশ্যই মালিকদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। বিশেষত:

  • ঘাতকের অনুপস্থিতি: যদি সড়ক হত্যাকাণ্ডের পরে ঘাতক চালককে খুঁজে না পাওয়া যায়, তবে পরিবহন মালিককেই সাজার আওতায় আনতে হবে।
  • ত্রুটিপূর্ণ বা অদক্ষ চালক নিয়োগ: ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন বা লাইসেন্সবিহীন/মাদকাসক্ত চালক নিয়োগের জন্য মালিকদের শাস্তির বিধান আইনে যুক্ত করতে হবে।
  • যানবাহন বাজেয়াপ্তকরণ: সড়কে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত যানবাহনটি মূল আসামী গ্রেপ্তার না হওয়া পর্যন্ত থানার জিম্মায় রাখার বিধান চালু করা আবশ্যক।

এই পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়িত হলে মালিকদের ওপর অর্থনৈতিক ও ফৌজদারি চাপ সৃষ্টি হবে, যা তাদের মানহীন যানবাহন (ফিটনেসবিহীন) এবং অদক্ষ চালক নিয়োগ থেকে বিরত রাখবে। মালিকের অর্থনৈতিক দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করাই সড়ক নিরাপত্তার মৌলিক উন্নতি আনতে পারে।

৪.৩ কঠোর গতিসীমা নির্ধারণ ও অ্যালকোহল সেবনে জিরো টলারেন্স নীতি

সড়ক নিরাপত্তা উন্নত করার জন্য আন্তর্জাতিকভাবে প্রমাণিত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রয়োগ প্রয়োজন। বিশেষজ্ঞ ও নীতি বিশ্লেষকদের পক্ষ থেকে কঠোর গতিসীমা নির্ধারণের সুপারিশ করা হয়েছে:

  • শহরের রাস্তায়: সর্বোচ্চ গতিসীমা ৪০ কিমি/ঘণ্টা
  • হাইওয়েতে (কার/মোটরসাইকেল): সর্বোচ্চ গতিসীমা ৯০ কিমি/ঘণ্টা
  • উচ্চ পদচারী ঘনত্বপূর্ণ এলাকায়: সর্বোচ্চ গতিসীমা ৩০ কিমি/ঘণ্টা

এই সুনির্দিষ্ট গতিসীমা প্রয়োগ সড়ক দুর্ঘটনার হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমাতে পারে।

এছাড়াও, মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালানোর ক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিকা অনুযায়ী জিরো টলারেন্স নীতি (Zero Tolerance Policy) গ্রহণের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। প্রস্তাবনা অনুযায়ী, রক্তে অ্যালকোহলের মাত্রা ০.০২ গ্রাম/ডেসিলিটার ($0.02\text{g}/\text{dl}$) এর বেশি হলেই তাকে দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য করার বিধান আইনে যুক্ত করতে হবে। এই ধরনের প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা কেবল অপরাধের পরে শাস্তির চেয়ে অপরাধ ঠেকানোর দিকে মনোনিবেশ করে, যা একটি আদর্শ আইনের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।

সমস্যা থেকে উত্তোরণের কৌশল ও দীর্ঘমেয়াদি সুপারিশমালা

বাংলাদেশের ট্রাফিক ও সড়ক নিরাপত্তার সমস্যা সমাধানে একটি সমন্বিত, কার্যকর ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার প্রয়োজন। এই পরিকল্পনা আইন, প্রশাসন, প্রযুক্তি এবং অবকাঠামো—এই চারটি স্তম্ভের ওপর নির্ভরশীল হওয়া উচিত।

৫.১ প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রশাসনিক সংস্কার: বিআরটিএ-এর শুদ্ধি অভিযান

১. ডিজিটাল রূপান্তর ও দুর্নীতি দমন: বিআরটিএতে দালাল চক্রের মাধ্যমে দুর্নীতি বন্ধ করতে লাইসেন্সিং ও ফিটনেস নবায়ন প্রক্রিয়াকে সম্পূর্ণরূপে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে (বিআরটিএ সার্ভিস পোর্টাল বা BSP) নিয়ে যেতে হবে। স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মানবিক হস্তক্ষেপ কমানো হলে দালাল চক্রের উৎখাত সম্ভব।

২. পরীক্ষা পদ্ধতির সংস্কার: ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদানের মান আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নীত করতে হবে। কেবল ফিল্ড টেস্ট নয়; মনস্তাত্ত্বিক, আচরণগত এবং ডোপ টেস্টসহ আরও কঠোর স্বাস্থ্য পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে। এটি প্রাথমিক নিরাপত্তা গেটওয়ে হিসেবে বিআরটিএ-কে কার্যকর করে তুলবে।

৩. ডাটা সমন্বয় সেল গঠন: সড়ক দুর্ঘটনার সঠিক এবং নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, বিআরটিএ এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি যৌথ ডাটা সমন্বয় সেল গঠন করা অপরিহার্য। নিসচার মতো বেসরকারি সংস্থাগুলোও এই দাবির পক্ষে মতামত দিয়েছে। সঠিক তথ্যের ভিত্তিতে নীতি প্রণয়ন করা হলে সম্পদের অপচয় কমবে।

৫.২ ইন্টেলিজেন্ট ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট (ITS) এর কার্যকরী বাস্তবায়ন

১. সমন্বিত একক কর্তৃপক্ষ: ঢাকার ট্রাফিক সিগন্যাল ব্যবস্থাপনার জন্য গত দুই দশকে ৩০০ কোটি টাকার বেশি অপচয় হয়েছে সমন্বয়হীনতার কারণে। এই ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে সিগন্যাল ব্যবস্থাপনার পুরো দায়িত্ব পুলিশ বিভাগ বা একটি একক, প্রযুক্তি-সক্ষম সংস্থার হাতে ন্যস্ত করতে হবে, যাতে সিটি কর্পোরেশন ও পুলিশের মধ্যে চলমান সমন্বয়হীনতা দূর হয়।

২. প্রযুক্তিগত আধুনিকায়ন ও বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতি: ঢাকার মিশ্র ট্রাফিকের জন্য উপযুক্ত এবং গতিশীল (Dynamic) সিগন্যালিং সিস্টেম চালু করতে হবে। প্রতিটি প্রকল্পের ব্যর্থতার কারণ বিশ্লেষণ করে ভবিষ্যতে বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতি অনুসরণ করার নিশ্চয়তা দিতে হবে।

৩. স্বয়ংক্রিয় এনফোর্সমেন্ট (e-Ticketing): সিগন্যাল অমান্যকারী গাড়ির নম্বর স্বয়ংক্রিয়ভাবে ক্যামেরায় শনাক্ত করে ইলেকট্রনিক মেসেজের মাধ্যমে মামলার প্রক্রিয়া (e-ticketing) কার্যকর করা উচিত। এই পদ্ধতি ম্যানুয়াল এনফোর্সমেন্ট জনিত দুর্নীতির সুযোগ কমাবে এবং আইন প্রয়োগের স্বচ্ছতা ও কার্যকারিতা বাড়াবে।

৫.৩ নগর পরিকল্পনা ও অবকাঠামো উন্নয়ন

১. গণপরিবহণ উন্নয়ন এবং সময়সূচি সমন্বয়: যানজট নিরসনে উন্নত ও দক্ষ গণপরিবহন ব্যবস্থায় ব্যাপক বিনিয়োগ করতে হবে। একই সাথে, প্রাইভেট কারের ব্যবহার নিরুৎসাহিত করতে সরকারি ও বেসরকারি অফিস সময়সূচির সমন্বয় বা বিকল্প সময়সূচি (শিফটিং) চালু করা যেতে পারে, যা পিক আওয়ারে সড়কের চাপ কমাবে।

২. পথচারী ও সাইকেলবান্ধব অবকাঠামো: বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে, বিশেষত নেদারল্যান্ডসের সাইকেল সংস্কৃতির আদলে, বাংলাদেশেও সাইকেল চালানোর জন্য আলাদা পথ এবং পথচারীদের জন্য নিরাপদ ফুটপাথ ও পারাপার ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে। যেহেতু ডিএমপি কমিশনার সিটি কর্পোরেশনের উদাসীনতা উল্লেখ করেছেন, তাই আইনি কাঠামোর মধ্যেই নগর কর্তৃপক্ষকে দুর্বল অবকাঠামো বা রক্ষণাবেক্ষণের ব্যর্থতার জন্য জবাবদিহি করার ধারা থাকা প্রয়োজন।

৫.৪ জনসচেতনতা ও চালকের প্রশিক্ষণ

১. দায়বদ্ধতা বৃদ্ধি ও শিক্ষামূলক প্রচারণা: আইন মানার মানসিকতা উন্নয়নের জন্য জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করা জরুরি। পথচারীদেরও আইন মানতে উৎসাহিত করতে হবে (যেমন জেব্রা ক্রসিং বা পদচারী সেতু ব্যবহার)। একই সাথে, আইন লঙ্ঘন করলে স্বয়ংক্রিয় জরিমানা বা মামলার বিধান প্রয়োগের মাধ্যমে বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করা যেতে পারে।

২. বিশেষ প্রশিক্ষণ: সাম্প্রতিক BRTA পরিসংখ্যান অনুযায়ী মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার উদ্বেগজনকভাবে বেশি। এই ঝুঁকি কমাতে মোটরসাইকেল চালকদের জন্য বিশেষ এবং কঠোর প্রশিক্ষণ কর্মসূচির ব্যবস্থা করা উচিত।

উপসংহার

বাংলাদেশের ট্রাফিক ব্যবস্থা এবং সড়ক নিরাপত্তার বর্তমান পরিস্থিতি একটি বহুমাত্রিক নীতিগত ব্যর্থতাকে নির্দেশ করে। সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮-এর মতো একটি শক্তিশালী আইনি ভিত্তি থাকা সত্ত্বেও, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি (বিআরটিএ), নগর কর্তৃপক্ষের সমন্বয়হীনতা (সিটি করপোরেশন ও ট্রাফিক পুলিশ), এবং প্রযুক্তিগত উদ্যোগের পুনরাবৃত্ত ব্যর্থতা (৩০০ কোটি টাকার ITS অপচয়) সড়কে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে দেয়নি। আইন লঙ্ঘনের জন্য প্রতিদিন শত শত মামলা দায়ের হওয়া সত্ত্বেও, সামগ্রিক চিত্রের কোনো উন্নতি না হওয়া প্রমাণ করে যে সমস্যাটি কেবল আইন প্রয়োগের অভাব নয়, বরং আইন মানার মানসিকতা ও কাঠামোগত দুর্বলতার গভীরে প্রোথিত।

একটি নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হলে কেবল চালকদের ওপর কঠোর দণ্ড (যেমন ৩০২ ধারা পুনঃস্থাপন) আরোপ করাই যথেষ্ট নয়; বরং আইনকে প্রো-এক্টিভ হতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন: মালিকদের অর্থনৈতিক দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা, বিআরটিএ-কে দালালমুক্ত করে লাইসেন্সিং প্রক্রিয়াকে সম্পূর্ণ ডিজিটাল করা, এবং ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব একটি একক, প্রযুক্তি-সক্ষম কর্তৃপক্ষকে ন্যস্ত করা। প্রযুক্তিগত সমাধানের (যেমন e-ticketing) মাধ্যমে ট্রাফিক এনফোর্সমেন্টে স্বচ্ছতা আনা সম্ভব, যা সড়কের নিরাপত্তাকে উন্নীত করবে। নগর পরিকল্পনার ক্ষেত্রে গণপরিবহন এবং সাইকেল/পথচারীবান্ধব অবকাঠামোর ওপর জোর দেওয়াই দীর্ঘমেয়াদে যানজট ও বিশৃঙ্খলার স্থায়ী সমাধান আনতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *