অনলাইন জুয়া: বাংলাদেশে প্রভাব ও কুফল

অনলাইন জুয়া: বাংলাদেশের অর্থনীতি ও সমাজ জীবনে নীরব মহামারি

(প্রতিবেদক: জে এইচ সুমন, জনতা নিউজ)

সূচনা: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে নতুন বিপদ

তথ্য-প্রযুক্তির যুগে ইন্টারনেট এবং স্মার্টফোনের সহজলভ্যতা মানুষকে আধুনিক করে তুললেও, এটি নতুন সামাজিক অবক্ষয় এবং আর্থিক ঝুঁকির জন্ম দিয়েছে । বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে অনলাইন জুয়া বা বেটিং এক নীরব মহামারি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, যা বিশেষ করে তরুণ সমাজকে গভীরভাবে আসক্ত করে তুলছে । ক্যাসিনো সংস্কৃতি ২০১৯ সালে আলোচনায় আসার পর, বর্তমানে অনলাইন জুয়ার সাইট এবং অ্যাপসগুলির জনপ্রিয়তা অ্যাডাল্ট সাইটগুলির অনুসন্ধানের চাহিদাকেও ছাড়িয়ে গেছে ।   

বাংলাদেশ ফিনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) এবং পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)-এর তথ্যমতে, দেশে প্রায় ২০ লাখ মানুষ অনলাইন জুয়ার সাইটে নিবন্ধিত, যার মধ্যে প্রায় ৫ লাখ ব্যবহারকারী নিয়মিত জুয়া খেলেন । এই জুয়ার বাজার ২০২০ সালের তুলনায় ২০২৬ সালে আরও ৪.৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে । এই অনলাইন আসক্তি কেবল ব্যক্তিগত সর্বনাশই ডেকে আনছে না, বরং দেশের অর্থনীতি ও সামাজিক স্থিতিশীলতার উপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।   

অনলাইন জুয়া পরিচালনার কৌশল ও অর্থের উৎস

প্ল্যাটফর্মের প্রকৃতি ও ব্যবহারকারী

অনলাইন জুয়া হলো ডিজিটাল মাধ্যমে পরিচালিত এক ধরনের বাজির ব্যবস্থা, যেখানে ব্যবহারকারীরা ঘরে বসেই গেম খেলতে পারে এবং অর্থ বিনিয়োগ করে লাভ বা লোকসান হয় । এই প্ল্যাটফর্মগুলি সাধারণত বিদেশ—বিশেষ করে রাশিয়া, সাইপ্রাস, আফ্রিকা ও ভারত থেকে—পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়, যদিও দেশে এদের কিছু দালাল বা এজেন্ট কাজ করে । ‘বাবু৮৮’ এবং ‘জেটবাজ ডটকম’-এর মতো ওয়েবসাইটগুলো বাংলাদেশে খুব জনপ্রিয়, যার সার্চ চাহিদা অত্যন্ত বেশি ।   

জুয়ার প্রতি আসক্তদের মধ্যে ১৮ থেকে ৪০ বছর বয়সী তরুণ-তরুণী, শিক্ষার্থী, তরুণ কর্মজীবী এবং বেকার যুবকেরাই বেশি আকৃষ্ট হচ্ছেন । এই প্ল্যাটফর্মগুলো ব্যবহারকারীদের আকৃষ্ট করতে শুরুতে ডেমো অ্যাকাউন্টে অধিক লাভ দেখিয়ে ভিডিও তৈরি করে ।   

অবৈধ অর্থ লেনদেনের পদ্ধতি: হুন্ডি ও এমএফএস

অনলাইন জুয়ার সবচেয়ে বড় দিক হলো এর মাধ্যমে সংঘটিত ব্যাপক অর্থ পাচার। জুয়া খেলার জন্য অনুমোদনহীন ভার্চুয়াল মুদ্রা বা ক্রিপ্টোকারেন্সি কিনতে হয় । এই লেনদেন প্রধানত মুঠোফোনের আর্থিক সেবার (এমএফএস) মাধ্যমে সম্পন্ন হয়, যার মধ্যে বিকাশ, নগদ, রকেট এবং উপায় অন্যতম ।   

  • বিশাল আর্থিক ক্ষতি: সিআইডি সূত্রে জানা যায়, জুয়াড়িরা মোবাইল ব্যাংকিং সার্ভিসের মাধ্যমে মাসে ১৫০ কোটি টাকার বেশি অবৈধভাবে লেনদেন করে। এভাবে বছরে প্রায় ১,৬০০ কোটি থেকে ২,০০০ কোটি টাকা লেনদেন হয় । এই বিপুল পরিমাণ অর্থ হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে পাচার হয়, যা দেশের বৈদেশিক মুদ্রার (ডলার) রিজার্ভের উপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং মুদ্রাস্ফীতি বাড়ায় ।   
  • এজেন্ট নম্বর ভাড়া: জুয়ার টাকা লেনদেনে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের এজেন্ট নম্বর মোটা অঙ্কের কমিশনের বিনিময়ে জুয়াড়িদের কাছে ভাড়ায় খাটে । সিআইডি প্রায় দেড় হাজার এমন নম্বরের তথ্য পেয়েছে । এই এজেন্ট নম্বরগুলো প্রায়শই ভুয়া বা নামবিহীন পরিচয়ে তৈরি করা হয়, যা সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকে ।  
  • কর্তৃপক্ষের পদক্ষেপ: অবৈধ লেনদেন বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশ ফিনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে। অনলাইন জুয়া ও হুন্ডির কারবারে জড়িত থাকার সন্দেহে তিন বছরে প্রায় ৪৮ হাজার ৫৮৬টি ব্যক্তিগত এমএফএস হিসাব স্থগিত করা হয়েছে । এছাড়াও, বিএফআইইউ ২১ হাজার ৭২৫টিরও বেশি মোবাইল হিসাব বন্ধ করেছে, যার বেশিরভাগই বিকাশ, নগদ ও রকেটের ।   

সামাজিক ও মানসিক কুফল

অনলাইন জুয়ার আসক্তি যুব সমাজকে নৈতিক অবক্ষয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে । এটি মাদকের আসক্তির মতোই ক্ষতিকর হিসেবে বিবেচিত ।   

  • পারিবারিক সহিংসতা ও আত্মহনন: জুয়ার কারণে পরিবারে চরম অশান্তি, সহিংসতা এবং পারিবারিক ভাঙন সৃষ্টি হচ্ছে । জুয়ায় সব খুইয়ে ঋণগ্রস্ত হয়ে অনেকে আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছেন । গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে এক ব্যক্তি জুয়ায় ঋণ করে আত্মহনন করেন এবং দুই বছর আগে ঢাকায় এক বিটিসিএল কর্মকর্তা জুয়ায় সর্বস্বান্ত হয়ে স্ত্রী ও সন্তানকে হত্যা করেন ।   
  • অপরাধ বৃদ্ধি: জুয়ার টাকা জোগাড় করতে অনেকে চুরি, ছিনতাই, জালিয়াতি এবং অন্যান্য অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন । তরুণ প্রজন্ম বা শিক্ষার্থীরা এর ফলে হতাশাগ্রস্ত হয়ে মাদক সেবনের দিকে ঝুঁকে পড়ছে ।   
  • মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা: জুয়ার আসক্তি কেবল আর্থিক ক্ষতিই করে না, এটি মানসিক-স্বাস্থ্য সমস্যাও সৃষ্টি করে । এই আসক্তি মদ্যপান বা নেশাজাতীয় দ্রব্যের মতো দৃশ্যমান না হওয়ায় মোকাবেলা করা আরও কঠিন হতে পারে । আসক্তি থেকে মুক্তি পেতে মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষার কৌশল, যেমন ধ্যান ও পজিটিভ চিন্তা, জরুরি ।

আইনি কাঠামো ও সরকারি তৎপরতা

নতুন আইন ও শাস্তির বিধান

বাংলাদেশে জুয়া খেলা মূলত অবৈধ এবং ১৮৬৭ সালের পাবলিক জুয়া আইনে জনসমক্ষে জুয়া খেলা এবং ক্যাসিনো নিষিদ্ধ । তবে অনলাইন জুয়া নিয়ন্ত্রণে আইন ছিল দুর্বল। বর্তমানে সরকার সাইবার স্পেসে জুয়া বন্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে ।   

  • সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫: এই অধ্যাদেশের ২০ ধারা অনুযায়ী সাইবার স্পেসে জুয়া, জালিয়াতি ও প্রতারণার শাস্তি হবে ২ বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ এক কোটি টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড ।   
  • নিষিদ্ধ কাজসমূহ: আইন অনুযায়ী, সাইবার স্পেসে জুয়া খেলার জন্য অ্যাপ/পোর্টাল/ডিভাইস তৈরি বা পরিচালনা করা, খেলায় সহায়তা বা উৎসাহ প্রদান করা, এবং জুয়ার বিজ্ঞাপনে অংশগ্রহণ বা প্রচার চালানোও দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে । এমনকি জুয়া-সংক্রান্ত আর্থিক লেনদেন, প্রতারণা এবং জালিয়াতিও নিষিদ্ধ ।   

সরকারের সমন্বিত পদক্ষেপ

অনলাইন জুয়া বন্ধে সরকার ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অনুসরণ করছে । সিআইডি, বিটিআরসি, জাতীয় সাইবার সুরক্ষা এজেন্সি (এনসিএসএ), এবং বিএফআইইউ যৌথভাবে কাজ করছে ।   

  • ব্লকিং এবং মনিটরিং: সরকার জুয়ার প্রায় ৩,৫০০-টিরও বেশি সাইট বন্ধ করেছে । আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলি নিয়মিতভাবে জুয়ার অ্যাপস, ওয়েবসাইট, ইউটিউব ও ফেসবুক লিংক চিহ্নিত করে ব্লকিং বা অপসারণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানাচ্ছে ।   
  • বিজ্ঞাপন নিয়ন্ত্রণ: সরকার মিডিয়া কোম্পানি, সেলিব্রিটি এবং প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে জুয়ার বিজ্ঞাপন প্রচারের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে ।   
  • সিম ও অ্যাপস চিহ্নিতকরণ: সিআইডি সাইবার পুলিশ সেন্টার গত দুই মাসে জুয়ায় জড়িত ২ হাজারের বেশি সিম, ৬০০ সাইট এবং ৫০টি অ্যাপস চিহ্নিত করেছে ।   
  • সচেতনতা বৃদ্ধি: বিএফআইইউ প্রধান অবৈধ হুন্ডি, অনলাইন জুয়া, বেটিং, ফরেক্স ও ক্রিপ্টোকারেন্সি ট্রেডিং সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে প্রচার-প্রচারণা বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন ।   

উপসংহার: সম্মিলিত প্রতিরোধের আহ্বান

অনলাইন জুয়া বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও সমাজকে এক গভীর সঙ্কটের মুখে ঠেলে দিয়েছে, যেখানে কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে এবং অসংখ্য পরিবার ধ্বংসের পথে যাচ্ছে । যদিও সরকার নতুন সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ এবং সম্মিলিত মনিটরিং-এর মাধ্যমে কঠোর অবস্থান নিয়েছে, তবুও অপরাধীরা প্রতিনিয়ত নতুন সাইট ও ভিপিএন ব্যবহার করে এই চক্র চালাচ্ছে ।   

এই ‘বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরো’ অবস্থা কাটিয়ে উঠতে কেবল আইনি কঠোরতাই যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন: (১) প্রযুক্তিগতভাবে সাইট ও অ্যাপস বন্ধ করার পাশাপাশি কার্যকর ফিল্টারিং ব্যবস্থা , (২) মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্ট নম্বর ভাড়ায় খাটানো বন্ধ করতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর কঠোর নজরদারি, এবং (৩) পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সামাজিক সংগঠনগুলির মাধ্যমে তরুণ সমাজকে এই আসক্তি থেকে দূরে রাখতে সচেতনতা বৃদ্ধি । অনলাইন জুয়ার এই সর্বনাশা গ্রাস থেকে দেশকে রক্ষা করতে হলে সরকার, মিডিয়া, প্রযুক্তি কোম্পানি ও নাগরিক সমাজ—সবার সক্রিয় ও নৈতিক ভূমিকা অপরিহার্য ।   

তথ্যসূত্র (References)

প্রামাণিকতার জন্য ব্যবহৃত প্রধান উৎসগুলির মধ্যে রয়েছে:

১. সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫  ২. বাংলাদেশ ফিনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (BFIU) ও সিআইডি রিপোর্ট  ৩. গণমাধ্যম প্রতিবেদন ও বিশেষজ্ঞ বিশ্লেষণ  ৪. মনস্তত্ত্ব ও স্বাস্থ্য বিষয়ক প্রবন্ধ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *