কারবালা—খিলাফতের সংঘাত, ইমামদের আত্মত্যাগ এবং ইসলামের নৈতিক বিপ্লব
(প্রতিবেদক: জে এইচ সুমন, জনতা নিউজ)
ক. সূচনা: এক আদর্শের বিলুপ্তি এবং সংগ্রামের সূচনা
ইসলামের ইতিহাসের প্রাথমিক পর্যায় ছিল খোলাফায়ে রাশেদিনের স্বর্ণযুগ, যেখানে শাসনভার পরিচালিত হতো পরামর্শভিত্তিক এবং ন্যায়নীতির উপর ভিত্তি করে। এই আদর্শিক ভিত্তির পতনের মধ্য দিয়েই মুসলিম উম্মাহর প্রথম গুরুতর রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সঙ্কট (ফিতনা) শুরু হয়। কারবালার যুদ্ধ (৬১ হিজরি/৬৮০ খ্রিস্টাব্দ) নিছক একটি ঐতিহাসিক বা আঞ্চলিক সংঘাত ছিল না; এটি ছিল ইসলামের মূল আদর্শ—ইনসাফ (ন্যায়) ও শুরা (পরামর্শ)—এবং নব-উত্থিত রাজতন্ত্র (মুলক) বা স্বৈরতন্ত্রের মধ্যে চূড়ান্ত আদর্শিক সংঘাতের প্রতীক। এই প্রতিবেদন কারবালার ঘটনাকে একটি শোকাবহ কাহিনী হিসেবে নয়, বরং ইসলামের রাজনৈতিক খিলাফত থেকে রাজতন্ত্রে রূপান্তরের অনিবার্য পরিণতি হিসেবে বিশ্লেষণ করেছে।
ইসলামী খিলাফতের প্রশাসনিক আদর্শের উপর উমাইয়া বংশের স্বজনপ্রীতি ও প্রভাব বিস্তারের প্রতিক্রিয়াস্বরূপ হযরত উসমান (রা.)-এর শাসনামলের শেষদিকেই প্রথম ফিতনার সূত্রপাত ঘটেছিল। এই সময়ে বাইতুল মালের অর্থ আত্মসাৎ এবং রাষ্ট্রীয় তহবিলকে বংশীয় স্বার্থে ব্যবহারের বিরুদ্ধে জনগণের মধ্যে অসন্তোষ দানা বেঁধে ওঠে। এই প্রশাসনিক দুর্নীতি এবং ক্ষমতা দখলের মানসিকতাই কারবালার পথ তৈরি করেছিল। হযরত আলী (আ.) যখন চতুর্থ খলিফা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখন তিনি হযরত মুয়াবিয়া (রা.)-এর চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন, যিনি সিরিয়ায় একটি প্রায় স্বাধীন রাষ্ট্র পরিচালনা করছিলেন। হযরত আলীর (আ.) খেলাফতকে কেন্দ্র করে সংঘটিত সিফফিনের যুদ্ধ বাহ্যত হযরত উসমান (রা.)-এর হত্যার বিচারের অজুহাতে শুরু হলেও, হযরত আলী (আ.)-এর শাহাদাতের পর মুয়াবিয়ার পরবর্তী পদক্ষেপসমূহ স্পষ্ট করে দেয় যে তাঁর আসল উদ্দেশ্য ছিল ক্ষমতা দখল। কুফায় দেওয়া এক ভাষণে মুয়াবিয়া নিজেই ঘোষণা করেন: “আমি নামায রোযার জন্যে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিনি। বরং আমি তোমাদের শাসন ক্ষমতা দখল করার জন্যে যুদ্ধ করেছি এবং শেষপর্যন্ত আমি তা লাভও করেছি”। এই ক্ষমতা দখলের নীতিই খেলাফতের আদর্শকে রাজতন্ত্রের ভিত্তি দিয়ে প্রতিস্থাপিত করে।
খ. ইমাম হাসান (আ.): সন্ধি ও ধৈর্যের প্রজ্ঞা
হযরত ইমাম হাসান (আ.)-এর জীবনী এবং খেলাফত গ্রহণ
হযরত ইমাম হাসান (আ.) ছিলেন ইসলামের নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রিয় দৌহিত্র এবং হযরত আলী (আ.) ও ফাতিমা (রা.)-এর প্রথম পুত্র। রাসূল (সা.) তাঁকে এবং তাঁর ভাই হুসাইন (আ.)-কে জান্নাতি যুবকদের সর্দার বলে আখ্যায়িত করেছেন। আল্লাহ তাআলা স্বয়ং তাঁদের নাম নির্বাচন করেছিলেন। হযরত আলী (আ.)-এর শাহাদাতের পর জনগণের বাইয়াত (আনুগত্য জ্ঞাপন)-এর মাধ্যমে হযরত ইমাম হাসান (আ.) পরবর্তী খলিফা হিসেবে নির্বাচিত হন। শীয়াদের মতে, তিনি ছিলেন বারজন ইমামের মধ্যে দ্বিতীয়।
মুয়াবিয়ার ষড়যন্ত্র এবং সন্ধিচুক্তির প্রেক্ষাপট
ইমাম হাসান (আ.) খলিফা নির্বাচিত হওয়ার পরপরই মুয়াবিয়া (রা.) তাঁর বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন। একইসাথে তিনি সামরিক শক্তি প্রয়োগের পাশাপাশি কূটনীতির আশ্রয় নেন। মুয়াবিয়া বিপুল পরিমাণ ঘুষ প্রদানের মাধ্যমে ইমাম হাসান (আ.)-এর সেনাবাহিনীর সেনাপতি ও সমর্থকদের মধ্যে ষড়যন্ত্র ও দুর্নীতি ছড়িয়ে দেন। এই ষড়যন্ত্র এতটাই সফল হয়েছিল যে ইমামের প্রধান সেনাপতি ওবায়দুল্লাহ ইবনে আব্বাস তার একদল অনুসারী নিয়ে রাতের অন্ধকারে মুয়াবিয়ার পক্ষে পালিয়ে যান। ইমাম হাসান (আ.)-এর সেনাবাহিনীতে বিভেদ, মতবিরোধ এবং অভ্যন্তরীণ বিশ্বাসঘাতকতা দেখা দেওয়ায়, এমনকি তাঁর তাঁবুতে আক্রমণ ও লুটতরাজের ঘটনা ঘটায়, তিনি বুঝতে পারেন যে যুদ্ধ চালিয়ে গেলে তা মুসলমানদের মধ্যে এক ভয়াবহ গৃহযুদ্ধের সূত্রপাত ঘটাবে, যা ইসলামের মূল কাঠামোকেই ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এছাড়াও, তিনি ধারণা করেছিলেন যে এই অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলার সুযোগে বাইজান্টাইন সম্রাট কনস্তানতিন মুসলমানদের প্রথম কিবলা বায়তুল মোকাদ্দাস দখল করতে পারেন।
হাসান-মুয়াবিয়া সন্ধিচুক্তি এবং রাজতন্ত্রের উত্থান
এই জটিল পরিস্থিতিতে, ইসলামের স্বার্থ রক্ষার জন্য ইমাম হাসান (আ.) যুদ্ধ-বিরতি ও কূটনৈতিক পন্থার পথ বেছে নেন। হিজরি ৪০ সনে (৬৬১ খ্রিস্টাব্দে) মুয়াবিয়ার সাথে একটি সন্ধিচুক্তি সাক্ষরিত হয়। চুক্তির মূল শর্তগুলির মধ্যে ছিল: (১) মুয়াবিয়ার শাসন ক্ষমতা গ্রহণের পর তার মৃত্যুর পর খেলাফত পুনরায় ইমাম হাসান (আ.)-এর কাছে হস্তান্তর করা হবে এবং (২) ইমাম আলী (আ.) ও ইমাম হাসান (আ.)-এর অনুসারীদের উপর কোনোরূপ উৎপীড়ন করা হবে না। এই চুক্তির মাধ্যমে ইমাম হাসান (আ.) মুয়াবিয়ার রাজনৈতিক চরিত্র উন্মোচিত করার জন্য এক ধরনের ‘নীরব জিহাদ’-এর ভিত রচনা করেন।
মুয়াবিয়া ক্ষমতা লাভের পরপরই কুফায় এসে জনগণের উদ্দেশ্যে দেওয়া এক বক্তৃতায় সেই চুক্তি বাতিল বলে ঘোষণা করেন এবং বলেন, তিনি সেই চুক্তি পদদলিত করেছেন। তিনি তার এই বক্তব্যের মাধ্যমে রাজনীতি থেকে ধর্মকে পৃথক করার ইঙ্গিত দেন এবং জানান যে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার স্বার্থে তিনি যেকোনো নীতি লঙ্ঘন করবেন। মুয়াবিয়ার এই শাসন পদ্ধতি কোনো ইসলামী খেলাফত বা রাসূল (সা.)-এর উত্তরাধিকারী প্রশাসন ছিল না; বরং তা ছিল সম্পূর্ণ রাজতান্ত্রিক প্রশাসন 7। মুয়াবিয়া জনসমক্ষে নিজেকে ‘ইসলামী খলিফা’ বললেও বিশেষ বৈঠকগুলোতে নিজেকে রাজা বা বাদশাহ্ হিসেবে পরিচিত করতেন।
| শাসনকাল | শাসন কাঠামো | শাসক | শাসনের আদর্শিক ভিত্তি |
| ৬১০–৬৩২ খ্রি. | নবুয়ত ও ইসলামী রাষ্ট্র | হযরত মুহাম্মদ (সা.) | ওহী, শুরা, ইনসাফ |
| ৬৩২–৬৬১ খ্রি. | খোলাফায়ে রাশেদিন | চার খলিফা (আবু বকর থেকে আলী) | শুরা ভিত্তিক নির্বাচন, ধর্মীয় নীতিমালার কঠোর অনুসরণ |
| ৬৬১–৬৮০ খ্রি. | উমাইয়া খিলাফত (মুয়াবিয়া) | প্রথম মুয়াবিয়া (রা.) | রাজতন্ত্রের উত্থান (মুলক), ক্ষমতা দখলের নীতি, চুক্তি লঙ্ঘন |
মুয়াবিয়ার অত্যাচার ও ইমাম হাসানের (আ.) শাহাদাত
মুয়াবিয়া তার শাসনকে সুসংহত করার জন্য ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন। তিনি রাষ্ট্রের সকল মসজিদের মিম্বারগুলোতে হযরত আলী (আ.)-এর বিরুদ্ধে গালি ও কুৎসা রটানোর আদেশ দেন, যা বহু বছর ধরে অব্যাহত ছিল 7। অন্যদিকে, তিনি আহলে বাইতের (নবী পরিবারের) ফযিলত বা গুরুত্ব সম্পর্কে কোনো হাদীস বর্ণনাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন এবং সাহাবী বা খলিফাদের মহত্ব নিয়ে জাল হাদীস সৃষ্টির জন্য পুরস্কার ঘোষণা করেন।
সন্ধিচুক্তির প্রায় দশ বছর পর মুয়াবিয়া তার লম্পট এবং অনৈসলামী চরিত্রের অধিকারী পুত্র ইয়াজিদকে পরবর্তী খলীফা মনোনীত করার সিদ্ধান্ত নেন। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে ইমাম হাসান (আ.)-কে সবচেয়ে বড় বাধা মনে করা হয়। তাই ইয়াজিদের পথের কাঁটা সরাতে মুয়াবিয়ার ষড়যন্ত্রে ইমাম হাসান (আ.)-কে বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে শহীদ করা হয়। ৪৮ বছর বয়সে, সফর মাসের ২৮ তারিখে তিনি শাহাদতের অমৃত পান করেন। ইমাম হাসানের (আ.) এই প্রজ্ঞাসুলভ ধৈর্য এবং মুয়াবিয়ার প্রকৃত চেহারা উন্মোচিত হওয়া পরবর্তী হুসাইনী বিপ্লবের নৈতিক ভিত্তি তৈরি করে।
গ. ইমাম হুসাইন (আ.): সত্যের পক্ষে আপোসহীন সংগ্রাম
ইমাম হুসাইন (আ.)-এর মর্যাদা এবং মুয়াবিয়ার আমলে অবস্থান
ইমাম হুসাইন (আ.) ছিলেন নবী (সা.)-এর দ্বিতীয় দৌহিত্র এবং জান্নাতি যুবকদের সর্দার। রাসূল (সা.) ঘোষণা করেছেন যে, যে ব্যক্তি হাসান ও হুসাইনকে ভালোবাসবে, আল্লাহ তাকেও ভালোবাসবেন। হযরত ইমাম হাসান (আ.)-এর শাহাদাতের পর ৫০ হিজরি থেকে ৬১ হিজরি পর্যন্ত ১১ বছর তিনি ইমামতের দায়িত্ব পালন করেন। এই ১১ বছরের মধ্যে ১০ বছরই অতিবাহিত হয় মুয়াবিয়ার শাসনামলে।
মুয়াবিয়ার শাসনামলে ইমাম হুসাইন (আ.) প্রকাশ্যে কোনো সামরিক আন্দোলন থেকে বিরত থাকেন কারণ তিনি তাঁর ভাই ইমাম হাসান (আ.)-এর সম্পাদিত সন্ধিচুক্তির প্রতি নিবেদিত ছিলেন। তবে তিনি মুয়াবিয়ার অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড, যেমন সাহাবী হত্যা এবং দুর্নীতি, সম্পর্কে তাঁর চিঠিপত্রে তীব্র মতপার্থক্য তুলে ধরেন। তিনি মুয়াবিয়ার শাসনকে ‘বড় ফিতনা’ হিসেবে চিহ্নিত করে এর বৈধতাকে প্রশ্নের সম্মুখীন করেন।
ইয়াজিদের বাইয়াত প্রত্যাখ্যান (৬১ হিজরি)
মুয়াবিয়ার মৃত্যুর পর ৬১ হিজরি মোতাবেক ৬৮০ খ্রিস্টাব্দে তার অযোগ্য পুত্র ইয়াজিদ ক্ষমতা গ্রহণ করেন। ইয়াজিদ ইমাম হুসাইন (আ.) এবং আবদুল্লাহ ইবনুল জুবায়েরসহ অন্যান্য বিশিষ্ট সাহাবী পুত্রদের কাছ থেকে আনুগত্য (বাইয়াত) দাবি করেন। ইয়াজিদের চারিত্রিক স্খলন, প্রমোদ বিহারী জীবন এবং অবৈধকে বৈধ করার প্রবণতা ছিল সর্বজনবিদিত। ইমাম হুসাইন (আ.) অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে ইয়াজিদের বাইয়াত প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি ঘোষণা করেন: “যে ইসলামী পন্থাকে অবনমিত করেছে, হয়েছে প্রমোদ বিহারী, যে অবৈধকে বৈধ করেছে এবং দুর্বল-দারিদ্র্যের জীবনযাত্রা দোজখের পর্যায়ে নামিয়ে দিয়েছে আমি তার প্রতি আনুগত্য প্রকাশে প্রস্তুত নই”।
ইয়াজিদের প্রতি আনুগত্য অস্বীকার করার মাধ্যমে ইমাম হুসাইন (আ.) স্পষ্ট করে দেন যে তাঁর সংগ্রাম নিছক ক্ষমতার লড়াই ছিল না, বরং তা ছিল মহানবী (সা.)-এর দীনকে বিকৃতির হাত থেকে রক্ষা করা এবং উম্মতকে সংশোধন করার জন্য এক ঐতিহাসিক কর্মসূচি। তাঁর শাহাদাতের লক্ষ্যকে কোনোভাবেই খ্রিস্টবাদের ইসলামী সংস্করণ (আত্মত্যাগের মাধ্যমে পাপমোচন) হিসেবে দেখা ভ্রান্ত ধারণা।
মক্কা শরীফে আশ্রয় এবং কুফাবাসীর আমন্ত্রণ
বাইয়াত প্রত্যাখ্যানের পর ইয়াজিদ বাহিনী ইমাম হুসাইন (আ.)-কে মদীনায় বাধ্য করলে তিনি সেই পবিত্র শহরে যুদ্ধ ও ফাসাদ এড়াতে আত্মীয়-পরিজনসহ হিজরত করে মক্কা শরীফে চলে যান। তিনি আল্লাহর হুকুম অনুসারে হেরেম শরীফের অভ্যন্তরে (যেখানে ঝগড়া-বিবাদ বা খুন-খারাবী হারাম) নিরাপদ আশ্রয় চেয়েছিলেন। মক্কায় থাকাকালে তিনি হজের জন্য আগত মুসলিম বিশ্বের জনগণের উদ্দেশ্যে মিনার ভাষণে উমাইয়াদের স্বৈরাচারী শাসন সম্পর্কে সতর্কবার্তা পৌঁছিয়ে দেন।
মক্কায় থাকতেই কুফা থেকে লাগাতার চিঠি ও সংবাদবাহক আসতে শুরু করে। কুফাবাসীরা তাঁকে সেখানে আমন্ত্রণ জানায় এবং জানায় যে প্রায় দেড়শত চিঠিতে ৪০,০০০ লোক তাঁর হাতে বাইয়াত নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
ঘ. কুফাবাসীর বিশ্বাসঘাতকতা ও কারবালা অভিমুখে যাত্রা
মুসলিম ইবনে আকিলের শাহাদাত
কুফাবাসীর আমন্ত্রণের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য ইমাম হুসাইন (আ.) তাঁর চাচাতো ভাই মুসলিম ইবনে আকিল (রা.)-কে কুফায় প্রেরণ করেন। মুসলিম ইবনে আকিলের কাছ থেকে ইতিবাচক সংকেত পেয়ে ইমাম তাঁর পরিবার, বোন, বিবিগণ এবং দুগ্ধপোষ্য শিশুসহ মোট ৮৩ জনের একটি কাফেলা নিয়ে কুফার উদ্দেশ্যে মক্কা ত্যাগ করেন। তিনি ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যাত্রা করেননি, যা প্রমাণ করে যে তিনি সামরিক মোকাবিলা নয়, বরং কুফাবাসীর সমর্থনে একটি বিকল্প ইসলামি কেন্দ্র গড়ে তোলার প্রত্যাশা করেছিলেন।
তবে উমাইয়া গভর্নর উবাইদুল্লাহ ইবনে যিয়াদ কুফায় এসে কঠোর দমননীতি চালু করেন এবং জনগণের সমর্থন দ্রুত ভেঙে দেন। এর ফলস্বরূপ, মুসলিম ইবনে আকিল নির্মমভাবে শহীদ হন। ইমাম হুসাইন (আ.) যাত্রাপথে তাঁর শাহাদাতের খবর পান এবং সঙ্গী-সাথীগণ হতবাক হলেও তাঁরা তাঁদের লক্ষ্য থেকে পিছপা হননি। মুসলিম ইবনে আকিলের ছোট দুই পুত্র মুহাম্মদ ও ইব্রাহীমও পরবর্তীতে এজিদ বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে নিষ্ঠুরভাবে শহীদ হয়।
কারবালা প্রান্তরে প্রবেশ ও অবরোধ
কুফার পথে খলিফার ১,০০০ সৈন্যের একটি বাহিনী ইমাম হুসাইন (আ.)-এর কাফেলাকে বাধা দেয় এবং তাঁদেরকে পথ পরিবর্তন করতে বাধ্য করে। অবশেষে, ৬১ হিজরির ২ মুহাররম তারিখে ইমাম হুসাইন (আ.) ইরাকের কারবালা নামক সমভূমিতে শিবির স্থাপন করতে বাধ্য হন। সেখানে শীঘ্রই উমর ইবনে সাদ-এর নেতৃত্বে ৪,০০০ থেকে ৫,০০০ সৈন্যের বিশাল উমাইয়া বাহিনী এসে কাফেলাকে ঘিরে ফেলে এবং ফোরাত নদীর পানি থেকে বঞ্চিত করে চরম মানবিক চাপ সৃষ্টি করে।
আলোচনা সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়, কারণ উবাইদুল্লাহ ইবনে যিয়াদ শর্তবিহীন বাইয়াত ছাড়া ইমাম হুসাইন (আ.)-কে নিরাপদে চলে যাওয়ার অনুমতি দিতে অস্বীকার করেন। ইমাম হুসাইন (আ.) অত্যাচারী ইয়াজিদের কাছে মাথা নত করার শর্ত ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন।
ঙ. আশুরার মহাবিপর্যয়: ৬১ হিজরি, ১০ মুহাররম
আশুরার দিনে বীরত্ব ও আত্মত্যাগ
১০ মুহাররম, ৬১ হিজরি (১০ অক্টোবর ৬৮০ খ্রিস্টাব্দ), যা আশুরার দিন হিসেবে পরিচিত, সেই দিনই কারবালার যুদ্ধ শুরু হয়। এটি ছিল সংখ্যাগতভাবে চরম অসম একটি লড়াই। Imam হুসাইন (আ.) যুদ্ধের আগে তার সঙ্গীদের চলে যাওয়ার পূর্ণ স্বাধীনতা দিলেও, মাত্র ৭১ থেকে ৭৩ জন সঙ্গী ও পরিবারের সদস্য আমৃত্যু তাঁর পাশে থাকার সিদ্ধান্ত নেন।
যুদ্ধের ময়দানে ইমাম হুসাইন (আ.) তাঁর চূড়ান্ত নৈতিক অবস্থান তুলে ধরেন 3। তিনি দেখিয়ে দেন যে, যদি একজন জালিম শাসক অবৈধকে বৈধ করে দেয়, তবে তার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করা ইসলামের নীতি ও আদর্শের সাথে আপোস করার শামিল।
কারবালার প্রধান ঘটনাবলী (২-১০ মুহাররম, ৬১ হিজরি)
| তারিখ (হিজরি) | তারিখ (খ্রিষ্টাব্দ) | ঘটনা | ঐতিহাসিক গুরুত্ব |
| ২ মুহাররম | অক্টোবর ২, ৬৮০ | ইমাম হুসাইন (আ.)-এর কারবালা প্রান্তরে পৌঁছানো। | উমাইয়া বাহিনীর অবরোধের শুরু। |
| ৭ মুহাররম | অক্টোবর ৭, ৬৮০ | ফোরাত নদীতে অবরোধ আরোপ; কাফেলার জন্য পানি সরবরাহ বন্ধ। | যুদ্ধের চরম মানবিক চাপ সৃষ্টি। |
| ১০ মুহাররম (আশুরা) | অক্টোবর ১০, ৬৮০ | ইমাম হুসাইন (আ.) এবং ৭১-৭২ জন সঙ্গীর শাহাদাত। | ইসলামের ইতিহাসে সবচেয়ে মর্মান্তিক আত্মত্যাগ। |
ইমামের শাহাদাত এবং আহলে বাইতের বিপর্যয়
এই ভয়াবহ সংঘাতে নবী পরিবারের প্রায় সকল পুরুষ সদস্য নির্মমভাবে শহীদ হন। শহীদদের মধ্যে ছিলেন ইমামের ছেলে, ভাতিজা, এবং ভ্রাতারা। ছয় মাস বয়সী শিশুপুত্র আলী আল-আসগর ইবনে হোসেইনও শাহাদাত বরণ করেন। ইমাম হুসাইন (আ.)-এর শিরোচ্ছেদ করা হয়। এই ঘটনা মুসলিম ইতিহাসের সবচেয়ে মর্মান্তিক অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত।
আল্লামা ইবনে কাসির (রহ.)-এর মতো প্রখ্যাত সুন্নি ঐতিহাসিকরা স্বীকার করেন যে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর শাহাদাতে ব্যথিত হওয়া প্রতিটি মুসলিমের কর্তব্য এবং তিনি ছিলেন মুসলিম জাতির নেতা। কারবালার এই আত্মত্যাগ বাহ্যিকভাবে উমাইয়াদের বিজয় মনে হলেও, এটি ছিল নৈতিকতার বিজয়। ইমাম হুসাইন (আ.)-এর রক্তপাতের মাধ্যমে স্বৈরাচারের কাছে নতি স্বীকার না করার এক চিরন্তন আদর্শ প্রতিষ্ঠিত হয়।
চ. কারবালার সুদূরপ্রসারী ফলাফল এবং উত্তরাধিকার
আহলে বাইতের বন্দীত্ব ও হযরত জয়নাবের (সা. আ.) প্রতিবাদ
শাহাদাতের পর কারবালার বন্দীদের, যার মধ্যে ছিলেন চতুর্থ ইমাম হযরত যয়নুল আবেদীন (আ.) এবং হযরত যায়নাব (সা. আ.), উমর ইবনে সা’দের লস্কর বন্দী করে। তাঁদেরকে প্রথমে কুফায় উবাইদুল্লাহ ইবনে যিয়াদের দরবারে এবং পরে শামে (দামেস্কে) ইয়াজিদের দরবারে নিয়ে যাওয়া হয়।
বন্দী অবস্থায় হযরত যায়নাব (সা. আ.) অত্যাচারী ইয়াজিদের সামনে নির্ভীকভাবে প্রতিবাদী ভাষণ দেন। তাঁর এই বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা উমাইয়াদের জুলুমের মুখোশ উন্মোচিত করে দেয় এবং ইমাম হুসাইন (আ.)-এর বিপ্লবের বার্তা সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করে। দামেস্কে ইমামের পবিত্র মস্তক মুবারকে ইয়াজিদের বেত দিয়ে আঘাত করার ঘটনায় উপস্থিত সাহাবী আবু বারজাহ আল-আসলামী (রা.) জোরালো প্রতিবাদ জানান, যা ইয়াজিদের নৈতিক পরাজয় নিশ্চিত করে।
ইয়াজিদের পতন এবং প্রতিশোধমূলক বিদ্রোহ
কারবালার ঘটনার পর মুসলিম সমাজে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে কুফার অধিবাসী মুখতার ইবনে আবি উবায়েদ আল-সাকাফীর নেতৃত্বে এক শক্তিশালী বিদ্রোহ সংঘটিত হয় (৬৮৫ খ্রিস্টাব্দ)। মুখতারের বিদ্রোহীরা সাময়িকভাবে সরকার গঠন করে এবং কারবালার ঘটনায় সরাসরি জড়িত জালেমদের ধরে এনে প্রকাশ্যে তাদের জুলুমের কাহিনী শোনেন এবং শাস্তি দেন। মুখতারের এই কার্যক্রম কারবালার ইতিহাসের অনেক বিস্তারিত বিবরণ সংরক্ষণে সহায়তা করে।
মুসলিম উম্মাহর স্থায়ী আদর্শিক বিভাজন
কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা মুসলিম উম্মাহর মধ্যে বিদ্যমান রাজনৈতিক ও ধর্মতাত্ত্বিক বিভাজনকে স্থায়ী করে তোলে। এই সংঘাতের মূলে ছিল নেতৃত্বের আদর্শিক ভিত্তি নিয়ে মতপার্থক্য:
- শিয়া ধর্মতত্ত্ব: শিয়াপন্থীরা মনে করেন যে খেলাফত (ইমামত) নবী (সা.)-এর বংশ পরম্পরায় আহলে বাইতের মাধ্যমে পরিচালিত হওয়ার কথা ছিল। তাঁদের বিশ্বাস, অন্য সাহাবায়ে কেরামদের মাধ্যমে ষড়যন্ত্র করে আহলে বাইতকে নেতৃত্ব থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।
- সুন্নি ধর্মতত্ত্ব: সুন্নিপন্থীরা মনে করেন, মহানবী (সা.) কোনো নির্দিষ্ট বংশ পরম্পরা বা ব্যক্তিকে উত্তরসূরি মনোনীত করেননি। বরং তিনি তাঁর সাহাবীদের জন্য শুরা (পরামর্শ) দ্বারা নেতা নির্বাচনের পথ খুলে রেখে গেছেন। যদিও সুন্নিরা ইয়াজিদের কর্মকাণ্ডকে তীব্রভাবে নিন্দা করে এবং ইমাম হুসাইন (আ.)-এর শাহাদাতে সমবেদনা প্রকাশ করে, তবে তারা খোলাফায়ে রাশেদিনের নির্বাচনকে বৈধ মনে করে।
কারবালার এই বিয়োগান্তক ঘটনা বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতেও গভীর প্রভাব ফেলেছে। মীর মোশাররফ হোসেনের কালজয়ী উপন্যাস বিষাদ সিন্ধু এবং কাজী নজরুল ইসলামের অসংখ্য কবিতা এই ঘটনার অনুপ্রেরণায় রচিত 18।
ছ. উপসংহার: কারবালা—ন্যায় ও অন্যায়ের চিরন্তন প্রতীক
কারবালার ইতিহাস হলো খিলাফতের আদর্শিক পতনের এক রক্তাক্ত দলিল, যা স্পষ্টভাবে দেখিয়ে দেয় যে ক্ষমতা দখলের রাজনীতি যখন ইসলামের নামে পরিচালিত হয়, তখন তার পরিণতি কত ভয়াবহ হতে পারে। হযরত ইমাম হাসান (আ.)-এর প্রজ্ঞাসুলভ সন্ধি এবং হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-এর আপোসহীন শাহাদাত—এই দুই ভ্রাতার আপাত ভিন্ন পদক্ষেপ ছিল আসলে একই লক্ষ্যে পৌঁছানোর দুটি পরিপূরক কৌশল: একজন মুয়াবিয়ার মুখোশ উন্মোচন করেন এবং অন্যজন ইয়াজিদকে প্রত্যাখ্যান করে ইসলামের নৈতিক ভিত্তি রক্ষা করেন 9।
ইমাম হুসাইন (আ.)-এর শাহাদাত মুমিন মুসলমানের হৃদয়ে কিয়ামত পর্যন্ত ব্যথার সমীরণ ও সত্যের পথে সংগ্রামের প্রেরণা জুগিয়ে যাবে 8। এই ঘটনা সমগ্র মানবজাতিকে শিক্ষা দেয় যে ন্যায় এবং অন্যায়, সত্য ও মিথ্যা কখনও পারস্পরিকভাবে একসাথে থাকতে পারে না এবং জালিমের রক্তচক্ষুকে ভয় না করে ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনের জন্য আত্মোৎসর্গ করা অপরিহার্য 3। তাই কারবালার শিক্ষা আজও প্রাসঙ্গিক: “প্রত্যেক যুগেই কারবালা ঘটে, আর হুসাইনের আদর্শ প্রতিবার প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে” 24।
তথ্যসূত্র (References)
ঐতিহাসিক ঘটনার প্রামাণিকতার জন্য ব্যবহৃত প্রধান উৎসগুলির মধ্যে রয়েছে:
১. আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া (ইবনে কাসির) 3
২. সহিহ তিরমিজি 8
৩. মুসনাদ আহমদ 8
৪. উসদুল গাবাহ 25
৫. মাকতাল আল-হোসাইন (আবু মিকনাফ) 18
৬. ঐতিহাসিক পর্যালোচনা বিষয়ক প্রবন্ধাবলী 6
৭. সমকালীন ইতিহাস ও সীরাত গ্রন্থাবলী 26
