বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে কাঠামোগত সংকট ও টেকসই সংস্কারের কৌশলগত রূপরেখা
(প্রতিবেদক: জে এইচ সুমন, জনতা নিউজ)
প্রথম অধ্যায়: ভূমিকা ও সংকটের প্রেক্ষাপট
১.১. সাংবিধানিক ভিত্তি এবং সংকটের মাত্রা
বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫(ক) এবং ১৮(১) অনুচ্ছেদে নাগরিকদের জন্য স্বাস্থ্যসেবাকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। স্বাধীনতার পর প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, বিশেষত মাতৃ ও শিশুমৃত্যু হ্রাস এবং সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে দেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি লাভ করেছে। তবে এই সাংবিধানিক অঙ্গীকার পূরণের পথে বিদ্যমান আইনি কাঠামোর দুর্বলতা, প্রশাসনিক অস্পষ্টতা এবং সুশাসনের অভাব বড় বাধা সৃষ্টি করেছে। বর্তমানে স্বাস্থ্য খাতের সংকট এক নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে, যেখানে সংক্রামক রোগের প্রকোপ কমলেও অসংক্রামক রোগ (NCDs) প্রাধান্য বিস্তার করছে। সামগ্রিক স্বাস্থ্যসেবার দুর্বল মান, অপ্রতুলতা এবং অর্থনৈতিক ও ভৌগোলিক বৈষম্য জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় গভীর সংকট তৈরি করেছে।
কোভিড-১৯ মহামারি বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দীর্ঘদিনের কাঠামোগত দুর্বলতাগুলিকে প্রকাশ্যে এনে দেয়। সরবরাহ চেইন, সরঞ্জাম ক্রয় প্রক্রিয়া এবং মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনায় গুরুতর ঘাটতিগুলো এই সময়ে প্রকটভাবে প্রকাশিত হয়। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর এক গবেষণায় দেখা যায়, এই সংকটের মধ্যেও স্বাস্থ্য খাতে বিদ্যমান দুর্নীতি আরও গভীর হয় এবং ত্রাণ আত্মসাৎ, তথ্য প্রকাশে বিধিনিষেধ আরোপ এবং বিশেষজ্ঞ মতামত উপেক্ষা করে আমলাতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে দুর্নীতির নতুন সুযোগ তৈরি হয়। জেকেজি হেলথ কেয়ারের ভুয়া সনদ বিতরণের মতো উচ্চ-প্রোফাইল কেলেঙ্কারিগুলো প্রমাণ করে যে, সংকটকালে জনগণের আস্থার সংকট আরও বেড়েছে। এই সমস্যাগুলো মোকাবিলা করতে এবং জনমুখী স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও অংশগ্রহণের নীতির ওপর ভিত্তি করে একটি সুসংগঠিত সংস্কার প্রক্রিয়া জরুরি হয়ে পড়েছে।
১.২. স্বাস্থ্য খাতের চারটি প্রধান চালিকাশক্তি ও তাদের ব্যর্থতা
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের বর্তমান বিপর্যয় চারটি আন্তঃসম্পর্কিত কাঠামোগত দুর্বলতার ফল: দুর্নীতি, অসহযোগীতা ও সমন্বয়হীনতা, প্রযুক্তির অভাব এবং দারিদ্র্যতা (বা আর্থিক সুরক্ষার অভাব)। এই চারটি উপাদান একটি দুষ্টচক্র তৈরি করে, যা নাগরিকদের স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার মৌলিক অধিকারকে চরমভাবে ব্যাহত করছে। উদাহরণস্বরূপ, যখন ক্রয় প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি হয়, তখন প্রয়োজনীয় সচল যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হয় না বা দক্ষ জনবল নিয়োগ দেওয়া হয় না। এর ফলে সরকারি সেবার মান কমে যায়, সমন্বয়হীনতা বাড়ে, এবং রোগীরা বাধ্য হয়ে বেসরকারি খাতে যায়। এই বেসরকারি চিকিৎসা উচ্চ ব্যক্তিগত ব্যয় (OOPE) সৃষ্টি করে, যা দরিদ্র মানুষকে আর্থিক বিপর্যয়ের মুখে ফেলে দেয়। এই বিশ্লেষণ ইঙ্গিত করে যে স্বাস্থ্য খাতের সমস্যাগুলি কেবল বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং সুশাসনের মৌলিক নীতির ব্যর্থতার ফলাফল।
দ্বিতীয় অধ্যায়: শাসন ব্যবস্থার দুর্বলতা এবং প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি
২.১. দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিক উৎস বিশ্লেষণ
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) স্বাস্থ্য খাতের গভীরে প্রোথিত দুর্নীতির একাধিক উৎস চিহ্নিত করেছে। দুদকের প্রতিবেদন অনুসারে, কেনাকাটা, নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি, চিকিৎসাসেবা, এবং সরকারি ওষুধ সরবরাহের মতো ১১টি খাতে দুর্নীতি সবচেয়ে বেশি হয়। কমিশন মোট ২৫ দফা সুপারিশও প্রণয়ন করেছে।
কোভিড-১৯ মহামারির সময়, ত্রাণ ও প্রণোদনা কর্মসূচি থেকে তহবিল আত্মসাৎ, অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা আড়াল করার জন্য তথ্য প্রকাশে বিধিনিষেধ আরোপ করা এবং বিশেষজ্ঞদের মতামত অগ্রাহ্য করে আমলাতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। টিআইবি’র পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, এই সময়ে দুর্নীতি অতীতের তুলনায় অনেক বেশি ছিল। এই প্রবণতা প্রমাণ করে যে, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা জনস্বার্থ রক্ষার পরিবর্তে স্বার্থান্বেষী মহলের অর্থ আত্মসাতের সুযোগ তৈরি করছে।
২.২. ক্রয় ও লজিস্টিকস ফ্রড: অব্যবহৃত যন্ত্রপাতি এবং অর্থ আত্মসাৎ
স্বাস্থ্য খাতে সবচেয়ে বড় আর্থিক অনিয়মগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম ক্রয়ে দুর্নীতি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ক্রয় কমিটিতে নিরপেক্ষ ও দক্ষ কর্মকর্তার অভাব থাকায় বিপুল অর্থ আত্মসাতের সুযোগ তৈরি হয়। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আঁতাত করে প্রায়শই অপ্রয়োজনীয়, নিম্নমানের যন্ত্রপাতি ক্রয় করা হয়। এই কেনাকাটাগুলো জনস্বাস্থ্যের প্রয়োজন দ্বারা পরিচালিত না হয়ে, কমিশনের মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের লক্ষ্যেই পরিচালিত হয়।
এই দুর্নীতি ও অদক্ষতার ফলস্বরূপ, রাজধানীসহ সারাদেশে সরকারি হাসপাতালগুলোর প্রায় ৮৫ ভাগ পরীক্ষা-নিরীক্ষার যন্ত্রপাতি বিকল বা অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকে। উদাহরণস্বরূপ, ঢাকা, শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মোট ২৩৮টি যন্ত্রপাতি নষ্ট রয়েছে, যার মূল্য আনুমানিক ১০০ কোটি টাকা। যন্ত্রপাতি মেরামত প্রক্রিয়াও দীর্ঘসূত্রিতার শিকার, যেখানে মেরামত করার চেয়ে নতুন কেনার দিকেই কর্তৃপক্ষের মনোযোগ বেশি থাকে, কারণ এতে অর্থ পাওয়ার সুযোগ বেশি।
এই প্রযুক্তিগত ব্যর্থতা এবং দুর্নীতির মধ্যে একটি সরাসরি কার্যকারণ সম্পর্ক রয়েছে। অপ্রয়োজনীয় বা নিম্নমানের যন্ত্রপাতি ক্রয় এবং সেগুলোর রক্ষণাবেক্ষণে অবহেলার কারণে সরকারি হাসপাতালগুলো প্রয়োজনীয় সেবা দিতে পারে না। ফলস্বরূপ, রোগীদের, বিশেষ করে দরিদ্র রোগীদের, সিটিস্ক্যান বা এমআরআই-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার জন্য বেসরকারি হাসপাতালে যেতে হয়, যেখানে ফি বহুগুণ বেশি (সরকারি ২,০০০ টাকার পরীক্ষা বেসরকারি হাসপাতালে ১০,০০০-১৫,০০০ টাকা)। এই ব্যবস্থা ইচ্ছাকৃতভাবে সরকারি সেবার সরবরাহকে পঙ্গু করে উচ্চ ব্যক্তিগত ব্যয় (OOPE) চাপিয়ে দেয়, যা দুর্নীতিকে আর্থিক বিপর্যয়ের সাথে যুক্ত করে।
২.৩. মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনায় দুর্নীতি ও দালাল চক্রের দৌরাত্ম্য
নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি এবং প্রশিক্ষণার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে দলীয়করণ ও স্বার্থান্বেষী মহলের অর্থ আদায়ের অভিযোগ রয়েছে। এই দুর্নীতি মেধাকে উপেক্ষা করে অযোগ্য নেতৃত্বকে সামনে নিয়ে আসে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (BIDS)-এর গবেষণা অনুযায়ী, প্রায় ৬০ শতাংশ স্বাস্থ্য নেতৃত্বের পদ রাজনৈতিক প্রভাবে পূরণ হয়েছে, যা প্রশাসনিক সক্ষমতাকে হ্রাস করেছে। এই দুর্বল নেতৃত্ব সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং নীতি বাস্তবায়নে বাধা দেয়, যা স্বাস্থ্য শাসনের দিক থেকে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পিছিয়ে দিয়েছে (২০২৩ গ্লোবাল হেলথ সিকিউরিটি ইনডেক্সে ১১৩তম)।
স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে দালাল চক্রের দৌরাত্ম্য প্রশাসনিক দুর্বলতার আরেকটি ফল। হাসপাতালের কিছু কর্মচারী স্থানীয় দালালদের সমন্বয়ে সংঘবদ্ধ চক্র তৈরি করে। এই চক্র গ্রামের দরিদ্র ও অনভিজ্ঞ রোগীদের টার্গেট করে এবং সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার অপ্রতুলতার কথা বলে তাদের মধ্যে ভীতি সৃষ্টি করে। এরপর রোগীদের বেসরকারি হাসপাতাল বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পাঠিয়ে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত কমিশন আদায় করে। এর ফলে সাধারণ রোগীরা হয়রানি, ভোগান্তি এবং আর্থিক অপচয়ের শিকার হন।
তৃতীয় অধ্যায়: সমন্বয়হীনতা, জনবল সংকট ও পেশাগত অসহযোগীতা
৩.১. প্রশাসনিক খণ্ডিতকরণ ও সমন্বয়হীনতা
দেশের স্বাস্থ্য খাতে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি না আসার অন্যতম প্রধান কারণ হলো প্রশাসনিক সমন্বয়হীনতা। মাঠ পর্যায় থেকে শুরু করে মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ স্তর পর্যন্ত—মন্ত্রী, সচিব এবং অধিদপ্তরের মধ্যে বড় ধরনের সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। প্রশাসনিক অস্পষ্টতা এবং সমন্বয়হীনতা সরাসরি সেবার মান হ্রাস করেছে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও ক্ষমতা কুক্ষিগত করার প্রবণতা প্রায়শই বিশেষজ্ঞ মতামতকে অগ্রাহ্য করে। উদাহরণস্বরূপ, হঠাৎ করে করোনার বুলেটিন প্রচার বন্ধ করা বা গণমাধ্যমে অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের কথা বলতে নিষেধ করা—এগুলো এক শ্রেণির আমলাদের ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার চেষ্টার ইঙ্গিত দেয়।
এছাড়াও, স্থানীয় পর্যায়ে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন কমিটিগুলোতে স্থানীয় সংসদ সদস্যদের যথাযথ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয় না বা তাদের সুপারিশ বাস্তবায়িত হয় না। ফলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ একতরফা হয় এবং স্থানীয় স্বাস্থ্য চাহিদা উপেক্ষা করা হয়। বিকেন্দ্রীকরণের অভাবে স্থানীয় পর্যায়ে যন্ত্রপাতি মেরামতের মতো সাধারণ সিদ্ধান্তও কেন্দ্রীয় অনুমোদনের জন্য মাসের পর মাস আটকে থাকে, যা সামগ্রিক সেবাকে ব্যাহত করে।
৩.২. জনবল সংকট এবং অসুষম বণ্টন
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় প্রায়শই ব্যাপক জনবল সংকটের মধ্য দিয়ে যায়। কেন্দ্র থেকে মাঠ পর্যায় পর্যন্ত মোট ৭৭ হাজার ৮৭৭টি পদ খালি রয়েছে, যা মোট পদের প্রায় ৩২ শতাংশ। নার্সিং ও মিডওয়াইফারি শ্রেণিতে শূন্য পদের হার সর্বোচ্চ (৬২%), এবং চিকিৎসকদের পদ খালি আছে প্রায় ৪০%।
এই সংকট বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) বৈশ্বিক মানদণ্ডের তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থানকে অত্যন্ত দুর্বল করে দিয়েছে। WHO-এর সুপারিশ অনুযায়ী প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য ডাক্তার, নার্স ও মিডওয়াইফ মিলে ৪৯ জন স্বাস্থ্যকর্মী প্রয়োজন হলেও, বাংলাদেশে এই সংখ্যা মাত্র ১৩ জন। যে সীমিত জনবল আছে, তাদেরও অসুষম বণ্টন একটি বড় সমস্যা। চিকিৎসকরা প্রত্যন্ত অঞ্চলে কাজ করতে চান না। ফলে শহর ও গ্রামের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবার প্রাপ্যতায় বিরাট বৈষম্য সৃষ্টি হয়।
৩.৩. পেশাগত অসহযোগিতা ও জবাবদিহিতার অভাব
জনবল ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা, যেমন পদোন্নতি ও অগ্রগতির সীমিত সুযোগ, এবং অতিরিক্ত কাজের চাপ—বিশেষ করে মেডিসিন, শিশুস্বাস্থ্য, অবেদনবিদ (অ্যানেসথেটিস্ট) এবং স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞদের ওপর—বিদ্যমান স্বাস্থ্যকর্মীদের মনোবলকে দুর্বল করে তোলে। অস্বাস্থ্যকর কর্মপরিবেশ এবং ব্যবস্থাপনার সাথে অসহযোগিতার মনোভাব কর্মীদের পেশাগত ‘বার্নআউট’ বা ক্লান্তির দিকে ঠেলে দেয়।
প্রশাসনিক দুর্বলতা এবং উচ্চ কাজের চাপের কারণে স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে এক ধরনের জবাবদিহিতার অভাব তৈরি হয় 21। এই পরিস্থিতি রোগীদের অধিকার নিশ্চিত করার পথে প্রধান বাধা। কেন্দ্রীয় ক্ষমতা কুক্ষিগত করার চেষ্টা, যেমন আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, জনবল সংকট দূর করার উদ্যোগকে ব্যাহত করে, যা বিদ্যমান কর্মীদের ওপর কাজের চাপ বাড়িয়ে পেশাগত অসহযোগিতাকে অনিবার্য করে তোলে।
চতুর্থ অধ্যায়: প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতা ও অবকাঠামোগত অদক্ষতা
৪.১. আধুনিক প্রযুক্তির অপ্রতুলতা ও অব্যবস্থাপনা
চিকিৎসা শিক্ষায় এবং রোগ নির্ণয়ে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার অপরিহার্য। প্রযুক্তি নির্ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং দক্ষতা বাড়াতে সাহায্য করে। বাংলাদেশে দামী দামী যন্ত্রপাতি কেনা হলেও, সরকারি হাসপাতালগুলোতে আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ সীমিত।
প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সমস্যাটি কেবল অপ্রতুলতার নয়, বরং অব্যবস্থাপনার। দুর্নীতিগ্রস্ত ক্রয় প্রক্রিয়ায় কেনা যন্ত্রপাতি, যেমন সিটিস্ক্যান, এক্স-রে, বা এমআরআই মেশিন, প্রায়শই হয় নিম্নমানের, অথবা সেগুলো পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষ জনবল নিয়োগ দেওয়া হয় না। যন্ত্রপাতি ক্রয় করা হয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আঁতাত করে সরকারি অর্থ লুটপাটের উদ্দেশ্যে, জনস্বার্থ নয়। ফলে উচ্চ বিনিয়োগ সত্ত্বেও যন্ত্রপাতিগুলো দীর্ঘদিন অব্যবহৃত থেকে নষ্ট হয়ে যায় (যেমন ঢাকা মেডিকেল কলেজের এমআরআই মেশিন সাত মাস নষ্ট ছিল)। এই প্রযুক্তিগত অদক্ষতা প্রমাণ করে যে স্বাস্থ্য খাতে উচ্চ বিনিয়োগ সত্ত্বেও সম্পদের অপচয় হচ্ছে, যা সক্ষমতা তৈরি না করে কেবল অর্থ লুটপাটের পথ তৈরি করে।
৪.২. ই-হেলথ এবং টেলিমেডিসিনের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ
গ্রামীণ এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেখানে অভিজ্ঞ ডাক্তারের অভাব রয়েছে, সেখানে টেলিমেডিসিন এবং ই-হেলথ সমাধান স্বাস্থ্যসেবা সরবরাহের ব্যবধান ঘোচাতে পারে। ‘ডক্টর ইন আ বক্স’-এর মতো ভার্চুয়াল চিকিৎসা পদ্ধতিগুলো দূরবর্তী রোগীদের সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ এবং পরামর্শের সুবিধা দিতে পারে। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে টিকাদান কর্মসূচির মতো জনস্বাস্থ্য কার্যক্রম নিখুঁতভাবে পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে।
তবে ই-স্বাস্থ্য বাস্তবায়নে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান। জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি ২০১১ এবং ডিজিটাল স্বাস্থ্য কৌশল ২০২০-২৫-এর মতো আইনি কাঠামো ও কৌশলপত্র থাকা সত্ত্বেও, প্রশাসনিক অস্পষ্টতা এবং তথ্যভিত্তিক বিশ্লেষণের ঘাটতি এর কার্যকারিতাকে সীমিত করেছে। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৬৭ শতাংশ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সার্ভিস চার্টার বা তথ্যভিত্তিক বিশ্লেষণের অভাব রয়েছে। এই ব্যর্থতাগুলো নির্দেশ করে যে প্রযুক্তিনির্ভর স্বাস্থ্য ব্যবস্থার রূপান্তরকে ত্বরান্বিত করতে প্রশাসনিক দক্ষতা বৃদ্ধি ও সমন্বয় অপরিহার্য।
পঞ্চম অধ্যায়: আর্থিক সুরক্ষা ও দারিদ্র্যতার প্রভাব
৫.১. বিপর্যয় সৃষ্টিকারী স্বাস্থ্য ব্যয় (Catastrophic Health Expenditure)
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক হলো জনগণের ওপর চাপানো স্বাস্থ্য ব্যয়ের ভয়াবহতা। বাংলাদেশ ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টস অনুসারে, মোট স্বাস্থ্য ব্যয়ের ৬৯ শতাংশ থেকে ৭৪ শতাংশ পর্যন্ত আসে রোগীর নিজস্ব পকেট থেকে (Out-of-Pocket Expenditure – OOPE)। সরকার বহন করে মাত্র ২৩ শতাংশ। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আফগানিস্তানের পরই (৭৭.২%) বাংলাদেশে ব্যক্তিগত পকেট ব্যয় সর্বোচ্চ।
এই উচ্চ OOPE মানুষের আয়ক্ষয়ের প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং এটি বিপর্যয় সৃষ্টিকারী অসুস্থতার মাধ্যমে দরিদ্র মানুষকে দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রে ফেলে দেয়। এই ব্যয়ের কারণে অনেকেই সঞ্চয় ভেঙে, সম্পদ বিক্রি করে চিকিৎসা নিতে বাধ্য হন, আর নিম্ন আয়ের বিশাল এক অংশ প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবাকে বিলম্বিত করে বা টাকার অভাবে চিকিৎসা বন্ধ করে দেয়। এই পরিস্থিতি প্রমাণ করে যে, বিদ্যমান স্বাস্থ্য অর্থায়নের কাঠামো সমাজের প্রান্তিক অংশকে আর্থিক সুরক্ষা দিতে পুরোপুরি ব্যর্থ।
৫.২. স্বাস্থ্য বাজেটের অপর্যাপ্ততা ও অদক্ষতা
উচ্চ OOPE-এর মূল কারণ হলো স্বাস্থ্য খাতে সরকারি বিনিয়োগের অপর্যাপ্ততা। বাংলাদেশ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) মাত্র ১.৫ শতাংশ স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় করে, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রস্তাবিত ৫ শতাংশের তুলনায় অনেক কম 28। এই স্বল্প বরাদ্দ মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে একটি বড় বাধা।
যদিও নাগরিকদের ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য ব্যয় কমানোর জন্য বাজেট বাড়ানোর পরামর্শ দেওয়া হয়, তবে বরাদ্দকৃত অর্থের ব্যবহারে অদক্ষতা একটি জটিল সমস্যা। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বরাদ্দের মাত্র ২.৯১ শতাংশ খরচ হয়েছে 29। বাজেট বাস্তবায়নে এই নিম্ন দক্ষতা প্রমাণ করে যে সমস্যাটি কেবল অর্থের স্বল্পতার নয়, বরং প্রশাসনিক সক্ষমতার অভাবেরও। এই অদক্ষতার কারণে কর্তৃপক্ষ বরাদ্দ বৃদ্ধি না করে যৌক্তিকভাবে বাজেট কাটছাঁট করার প্রস্তাব করে, যা স্বাস্থ্য বাজেটের রুগ্নদশা ফুটিয়ে তোলে।
৫.৩. স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তিতে অসাম্য
আর্থিক দুর্বলতার কারণে স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তিতে ব্যাপক অসাম্য সৃষ্টি হয়। এসডিজি অ্যাকশন অ্যালায়েন্সের তথ্যমতে, দেশের দরিদ্রতম ২০ শতাংশ পরিবার মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্যসেবার সরকারি সুবিধার মাত্র ২০ শতাংশও ভোগ করতে পারে না। স্বাস্থ্যসেবা অর্থায়ন কৌশলপত্র (২০১২-২০৩২) সম্পদের স্বল্পতা, অর্থবরাদ্দে অন্যায্যতা (Inequity) এবং ব্যবহারে অদক্ষতাকে এই বৈষম্যের প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। স্বাস্থ্য অর্থায়ন কাঠামোটি যদি দরিদ্রদের সুরক্ষা দিতে না পারে, তবে সাংবিধানিকভাবে নিশ্চিত করা স্বাস্থ্য অধিকার লঙ্ঘিত হতে থাকে।
ষষ্ঠ অধ্যায়: সমাধান ও টেকসই সংস্কারের কৌশলগত রোডম্যাপ
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের সংকট নিরসনে দ্রুত ও সুসংগঠিত সংস্কার প্রয়োজন। এই রোডম্যাপটি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এবং ২০২৫ সালের স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশনের সুপারিশের ওপর ভিত্তি করে প্রণয়ন করা হয়েছে।
ছক ১: বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে অর্থায়নের চিত্র এবং বৈশ্বিক মানদণ্ড
| সূচক | বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থান (গড়/সর্বশেষ) | বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) নির্দেশিত মানদণ্ড | উৎস |
| মোট স্বাস্থ্য ব্যয়ে ব্যক্তিগত পকেট খরচ (OOPE) (%) | ৬৯% – ৭৪% | ১৫% – ২০% এর নিচে | 24 |
| মোট জিডিপিতে স্বাস্থ্য বাজেট বরাদ্দ (%) | ১.০% – ১.৫% | ৫.০% (আদর্শ) | 28 |
| প্রতি ১০,০০০ জনসংখ্যায় স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা (ডাক্তার, নার্স, মিডওয়াইফ) | ১৩ জন | ৪৯ জন | 18 |
| সরকারি স্বাস্থ্য খাতের শূন্য পদের হার (%) | ৩২% (৭৭,৮৭৭টি পদ) | সর্বনিম্ন | 18 |
৬.১. শাসন ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার: বিকেন্দ্রীকরণ এবং জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা
স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় সুশাসন নিশ্চিত করার জন্য প্রশাসনিক সংস্কার জরুরি। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) প্রশাসনিক সুবিধার্থে স্বাস্থ্য অধিদফতরকে ভেঙে স্বাস্থ্যসেবা অধিদফতর এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতর নামে পৃথক দুটো অধিদফতর চালু করার প্রস্তাব করেছে। এছাড়াও, স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশন যোগ্যতার ভিত্তিতে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত নেতৃত্ব নির্বাচন নিশ্চিত করার উপর জোর দিয়েছে 4। প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস চিকিৎসা ব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকরণের এবং চিকিৎসকদের পোস্টিং স্থানে থাকা নিশ্চিত করার নির্দেশ দিয়েছেন।
৬.২. দুর্নীতি প্রতিরোধ ও স্বচ্ছতা বৃদ্ধি
দুর্নীতি প্রতিরোধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা অপরিহার্য।
- ক্রয় প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা: মেডিকেল ইকুইপমেন্ট ক্রয়ের ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও অনিয়ম বন্ধ করার জন্য ক্রয় কমিটিতে এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, জনবল না থাকলে সরঞ্জাম না কেনার বিধান করা এবং ই-জিপি (e-GP)-তে টেন্ডার অনুসরণ করা।
- জনস্বার্থে তথ্য প্রকাশ: সরকারি হাসপাতালগুলোতে জনসাধারণের দৃষ্টিগোচর হয় এমন উন্মুক্ত স্থানে সিটিজেন চার্টার প্রদর্শন করা। বর্তমানে ৬৭ শতাংশ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সার্ভিস চার্টার নেই, এই ঘাটতি দ্রুত দূর করতে হবে।
- ওষুধ ব্যবস্থাপনা: চিকিৎসকদের ব্যবস্থাপত্রে ওষুধের ট্রেড নাম না লিখে জেনেরিক নাম (Generic Name) লেখা বাধ্যতামূলক করা এবং নকল ওষুধ কারখানা বন্ধে স্বাস্থ্য অধিদফতরের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি নজরদারি দল (Surveillance Team) গঠন করা।
ছক ২: স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির চিহ্নিত ক্ষেত্র এবং প্রস্তাবিত সংস্কার (দুদক ও সংস্কার কমিশন অনুসারে)
| দুর্নীতির প্রধান ক্ষেত্র | দুর্নীতির ধরন ও প্রভাব | প্রস্তাবিত জরুরি সংস্কার (দুদক/কমিশন) | উৎস |
| নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতি | দলীয়করণ ও অর্থ আদায়, প্রত্যন্ত অঞ্চলে ডাক্তারের অনীহা | সুনির্দিষ্ট বদলি নীতিমালা, পিএসসি-ভিত্তিক পদোন্নতি কমিটি, উপজেলায় ২ বছরের ইন্টার্নশিপ বাধ্যতামূলক | 10 |
| যন্ত্রপাতি ক্রয় ও মেরামত | অপ্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ক্রয়, অর্থ আত্মসাৎ, যন্ত্র বিকল থাকা | ক্রয় কমিটিতে বিশেষজ্ঞ অন্তর্ভুক্তি, জনবল না থাকলে সরঞ্জাম না কেনা, ইজিপি অনুসরণ | 8 |
| ওষুধ ও সরবরাহ | সরকারি ওষুধ কালোবাজারে বিক্রি, নিম্নমানের ওষুধ | ব্যবস্থাপত্রে জেনেরিক নাম লেখা বাধ্যতামূলক, নজরদারি দল গঠন | 10 |
| দালাল চক্রের দৌরাত্ম্য | রোগীদের জিম্মি করে ব্যক্তিগত আর্থিক শোষণ | উন্মুক্ত সিটিজেন চার্টার প্রদর্শন, হাসপাতাল কর্মীদের নজরদারি ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ | 8 |
৬.৩. আর্থিক সুরক্ষা: UHC অর্জন এবং OOPE হ্রাস কৌশল
ব্যক্তির নিজস্ব পকেট ব্যয় হ্রাস করা এবং সর্বজনীন স্বাস্থ্য কাভারেজ (UHC) অর্জন করা অপরিহার্য।
- সরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি: স্বাস্থ্য খাতে সরকারি বিনিয়োগকে জিডিপি’র ন্যূনতম ২ শতাংশে উন্নীত করে ক্রমান্বয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রস্তাবিত ৫ শতাংশের দিকে নিয়ে যেতে হবে 28। বাজেট যেন অব্যয়িত না থাকে, সেজন্য জনবল নিয়োগ ও চিকিৎসা সামগ্রী ক্রয়ের মতো সুনির্দিষ্ট খাতগুলোতে বরাদ্দ বাড়ানো প্রয়োজন।
- স্বাস্থ্য বিমা চালু: সকল নাগরিকের জন্য স্বাস্থ্য বিমা (Health Insurance) চালুকরণ দুদকের অন্যতম প্রধান সুপারিশ। দরিদ্রসীমার নীচে বসবাসকারীদের জন্য ‘স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচি (SSK)’ দ্রুত সম্প্রসারিত করতে হবে। এই কর্মসূচির অধীনে চিহ্নিত পরিবারগুলো ৫০টি রোগের চিকিৎসা বিনামূল্যে পাবে।
- আদর্শ মডেল বিশ্লেষণ: ভারত সরকারের ‘আয়ুষ্মান ভারত’ প্রকল্পের মতো সফল সামাজিক স্বাস্থ্য বীমা মডেল বিশ্লেষণ করা যেতে পারে, যেখানে ১০ কোটিরও বেশি দরিদ্র পরিবারকে বার্ষিক ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত মাধ্যমিক ও উচ্চতর চিকিৎসার সহায়তা প্রদান করা হয়।
৬.৪. মানবসম্পদ ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা উন্নয়ন
জনবল সংকট দূর করতে এবং পেশাগত মান উন্নত করতে সুনির্দিষ্ট কৌশল গ্রহণ করতে হবে।
- উপজেলা পর্যায়ে জনবল নিশ্চিতকরণ: ইন্টার্নশিপের মেয়াদ এক বছর থেকে বাড়িয়ে দুই বছর করা এবং বর্ধিত এক বছর উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালে থাকা বাধ্যতামূলক করা। উপজেলা পর্যায়ে কাজ না করলে উচ্চ শিক্ষার অনুমতি না দেওয়ার বিধান করলে প্রত্যন্ত অঞ্চলের চিকিৎসকের অভাব দূর হতে পারে।
- প্রশিক্ষণ ও নৈতিকতা: চিকিৎসকদের প্রতি তিন মাস অন্তর নৈতিকতা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রাখা প্রয়োজন।
- প্রযুক্তির প্রয়োগ: ডিজিটাল স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এবং টেলিমেডিসিনের সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর জন্য ২০২৫-৩০ সালের রোডম্যাপ দ্রুত বাস্তবায়ন করা উচিত। বিশেষ করে টেলিমেডিসিন এবং ই-হেলথ টুলস ব্যবহার করে মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে।
উপসংহার: ভবিষ্যতের জন্য নীতিগত নির্দেশিকা
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের মূল সমস্যাগুলো—দুর্নীতি, প্রশাসনিক সমন্বয়হীনতা, প্রযুক্তির অব্যবস্থাপনা এবং অপর্যাপ্ত আর্থিক সুরক্ষা—একে অপরের সাথে গভীরভাবে যুক্ত। দুর্নীতি সরকারি সেবার সক্ষমতাকে পঙ্গু করে দেয় এবং বাধ্য করে সাধারণ মানুষকে উচ্চ ব্যক্তিগত ব্যয় বহন করতে, যা দারিদ্র্যের চক্রকে তীব্র করে।
স্বাস্থ্য বিষয়ক সংস্কার কমিশন (২০২৫)-এর প্রতিবেদনে উল্লেখিত সংস্কারগুলি বাস্তবায়নে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। বিশেষ করে, চিকিৎসা ব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকরণ এবং চিকিৎসকদের পোস্টিং স্থানে থাকা নিশ্চিত করার মাধ্যমে প্রশাসনিক দুর্বলতা দূর করা অপরিহার্য। একটি জনমুখী, ন্যায়ভিত্তিক ও স্থিতিস্থাপক স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে সরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি, সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা (UHC) নিশ্চিত করা এবং দুদকের সুপারিশ মেনে কঠোর প্রশাসনিক ও ক্রয় সংস্কারের মাধ্যমে দুর্নীতির মূলোৎপাটন করা জরুরি। এই সংস্কারগুলি বাস্তবায়নে বিলম্ব হলে তা লাখ লাখ জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য ও কল্যাণকে বিপন্ন করে তুলবে। দৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকার এবং স্বচ্ছ জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই কেবল বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত জনগণের আস্থার প্রতীক হয়ে উঠতে পারে।
