শিক্ষা খাতে দুর্নীতি ও অসহযোগিতা: সমাধান

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষত: দুর্নীতি, অসহযোগীতা ও উত্তরণের পথ

(প্রতিবেদক: জে এইচ সুমন, জনতা নিউজ)

১. মুখবন্ধ: মানবসম্পদ উন্নয়নে দুর্নীতির প্রভাবের সংকট

১.১. ভূমিকা ও কেন্দ্রীয় থিসিস

শিক্ষা একটি জাতির ভবিষ্যতের ভিত্তি হিসেবে মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি। তবে বাংলাদেশে এই অতীব গুরুত্বপূর্ণ খাতটি কাঠামোগত দুর্নীতি এবং প্রাতিষ্ঠানিক নিষ্ক্রিয়তার (যা ‘অসহযোগীতা’ হিসেবে বিশ্লেষিত) বিষাক্ত জালে আবদ্ধ। এই সর্বগ্রাসী দুর্নীতি কেবল আর্থিক অপচয়ই ঘটায় না, বরং শিক্ষার গুণগত মানকে ধ্বংস করে, মেধার অবমূল্যায়ন করে এবং সামাজিক ন্যায়বিচারকে মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ণ করে চলেছে। এই প্রতিবেদনটি বাংলাদেশের শিক্ষা খাতের দুর্নীতির বহুস্তরীয় স্বরূপ উন্মোচন করবে, আমলাতান্ত্রিক রেন্ট-সিকিং ও বিচারহীনতার কারণে সৃষ্ট ‘অসহযোগীতা’ বিশ্লেষণ করবে এবং গবেষণা-ভিত্তিক তথ্য ও আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতার আলোকে সুনির্দিষ্ট, কাঠামোগত সমাধানের পথ প্রস্তাব করবে।

১.২. ‘অসহযোগীতা’ বনাম প্রাতিষ্ঠানিক নিষ্ক্রিয়তার সংজ্ঞা

শিক্ষা খাতে ‘অসহযোগীতা’ বলতে স্রেফ অদক্ষতা বা সম্পদের অভাবজনিত ত্রুটি বোঝায় না। এটি মূলত দুর্বল প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো, আমলাতন্ত্রের রাজনৈতিকীকরণ 3 এবং জবাবদিহিতার অভাবে সৃষ্ট ইচ্ছাকৃত নিষ্ক্রিয়তা বা পাশবিক উদাসীনতাকে নির্দেশ করে। এর ফলস্বরূপ, দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশগুলো বাস্তবায়িত হয় না, এমনকি যখন জাল সনদধারী শিক্ষকদের তথ্য প্রমাণ হয়, তখনো তারা বহাল তবিয়তে চাকরি করতে থাকেন। একইভাবে, আইনি প্রক্রিয়াগুলো অকার্যকর প্রমাণিত হয়, যেমন প্রশ্নপত্র ফাঁসের মতো গুরুতর অপরাধের প্রায় ৯৮ শতাংশ মামলা আদালতে টেকে না 5। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) সিপিআই ২০২৪-এর প্রতিবেদনে এই দুর্নীতিকে ‘ফলেন ক্লেপটোক্র্যাটিক এবং কর্তৃত্ববাদী শাসনের ফলশ্রুতি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে, যা ইঙ্গিত করে যে দুর্নীতির প্রশ্রয় উচ্চ রাজনৈতিক স্তর থেকে আসছে।

১.৩. দুর্নীতির দ্বিমুখী চালক: প্রাতিষ্ঠানিক রেন্ট-সিকিং ও চাহিদা-চালিত দুর্নীতি

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় দুর্নীতির মূল চালক হলো ‘টপ-ডাউন’ প্রাতিষ্ঠানিক রেন্ট-সিকিং (আমলাতান্ত্রিক রেন্ট সিকিং) এবং ‘বটম-আপ’ চাহিদা-চালিত দুর্নীতির (ডিমান্ড-সাইড করাপশন) একটি বিষাক্ত মিথস্ক্রিয়া। শিক্ষা সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তিরা ক্ষমতার অবস্থানে থাকায় তারা পরিবার এবং তরুণ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অবৈধ সুবিধা আদায় করতে সক্ষম হন। উচ্চপদস্থ আমলাদের দুর্নীতি যখন একটি ‘চেইন অফ করাপশন’ তৈরি করে, তখন নিম্নস্তরের শিক্ষকরাও জীবিকার অনিশ্চয়তা বা উচ্চপদস্থদের প্রভাবে পেটি ব্রাইবারিতে লিপ্ত হতে বাধ্য হন। তারা কোচিং বাণিজ্য, অতিরিক্ত ফি আদায় বা অন্যান্য উপায়ে দুর্নীতি করেন 1। একইসঙ্গে, সন্তানের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে মরিয়া অভিভাবকরা সঠিক তথ্য না জেনে অথবা জেনেশুনেও অবৈধ লেনদেন গ্রহণ করে দুর্নীতির এই চাহিদা-পার্শ্বকে সক্রিয় রাখেন।

২. ঐতিহাসিক পটভূমি ও কাঠামোগত কারণসমূহ

২.১. দুর্নীতির ঐতিহাসিক পটভূমি ও রাজনৈতিক অর্থনীতির বিশ্লেষণ

শিক্ষা খাতে দুর্নীতি নামক ‘কালব্যাধি’ বাংলাদেশে নতুন নয়। এর স্বরূপ ও কারণ উন্মোচনে রাজনৈতিক অর্থনীতির বিশ্লেষণ জরুরি। গত সরকারের শেষের দিকে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশকে দুর্নীতির বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন প্রমাণ করে একটি গবেষনা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। দুর্নীতিকে সাধারণত ‘রেন্ট সিকিং’ বা অবৈধ সুবিধা আদায়ের প্রচেষ্টা হিসেবে বর্ণনা করা হয়। বাংলাদেশে আমলাতন্ত্রের অদক্ষতা ও দুর্নীতি মূলত দলীয় রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় তাদের অংশগ্রহণের ফল। যখন কর্মকর্তারা দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে কাজ করেন, তখন তারা তাদের বিবেচনামূলক ক্ষমতা (Discretionary Power) ব্যবহার করে ‘রেন্ট সিকিং’ করেন, যা সুশাসনের পথে প্রধান অন্তরায়।

২.২. দুর্নীতি সৃষ্টির মূল কারণসমূহের বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ

দুর্নীতির কারণ অনুসন্ধানে একাধিক বিষয় উঠে আসে। একদিকে যেমন নৈতিক মূল্যবোধ ও ধর্মীয় জবাবদিহিতার অভাবকে দায়ী করা হয়, তেমনি অন্যদিকে অর্থনীতিবিদরা বৈষয়িক ও অর্থনৈতিক কারণগুলোকেও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। সম্পদের স্বল্পতা ও অভাবের কারণে সরকার সব কর্মীকে পর্যাপ্ত ভাতা প্রদান করতে পারে না। সীমিত আয়, অর্থাভাব, আয়ের তুলনায় বেশি ব্যয় এবং ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা মানুষকে অসৎ পথে আয় করতে উৎসাহিত করে।

পাশাপাশি, বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা বিপুল সংখ্যক সার্টিফিকেটধারী তৈরি করলেও তারা প্রায়শই প্রকৃত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। একজন ব্যক্তি যখন বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করে চাকরি পেয়ে যায়, তখন প্রকৃত শিক্ষার অভাবের ফলেই ডিগ্রিধারী ব্যক্তিরা সহজেই দুর্নীতিসহ নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়েন। নীতিগত লক্ষ্য নির্ধারণ হলেও দুর্বল প্রতিষ্ঠান, অপর্যাপ্ত সম্পদ এবং রাজনৈতিক অঙ্গীকারের অভাবে সৃষ্ট জবাবদিহিতার ঘাটতি কার্যকর নীতি বাস্তবায়নে বাধা দেয়।

২.৩. অপ্রতুল বাজেট ও প্রাতিষ্ঠানিক রেন্ট-সিকিংয়ের বিষচক্র

শিক্ষায় অপ্রতুল বাজেট বরাদ্দ সম্পদের তীব্রতা সৃষ্টি করে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শিক্ষা খাতে বাংলাদেশের বরাদ্দের হার কম। এই তীব্রতাকে কাজে লাগিয়ে আমলারা, যাদের প্রায়শই রাজনৈতিক ছত্রছায়া রয়েছে 3, তাদের বিবেচনামূলক ক্ষমতার মাধ্যমে ঘুষ আদায় করে ‘হাদিয়া সংস্কৃতি’ তৈরি করে। ফলে সম্পদের অভাব এবং আমলাতান্ত্রিক ক্ষমতার যোগফল হলো রেন্ট-সিকিং এর অনুকূল পরিবেশ। এই প্রাতিষ্ঠানিক রেন্ট-সিকিং রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা দ্বারা সুরক্ষিত থাকায়, নৈতিক অবক্ষয়ের কথা বলা হলেও, প্রশাসন ও আইনি ব্যবস্থায় জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই কেবল এই সর্বগ্রাসী দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

৩. শিক্ষা খাতের স্তরভিত্তিক দুর্নীতির স্বরূপ ও উদাহরণ

শিক্ষা খাতে দুর্নীতি বিভিন্ন স্তরে প্রকটভাবে বিদ্যমান, যা সুনির্দিষ্ট উদাহরণ দ্বারা স্পষ্ট হয় এবং মানবসম্পদ উন্নয়নের ভিত্তিকে দুর্বল করে দিচ্ছে।

৩.১. নিয়োগ বাণিজ্য ও অযোগ্যতার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ

শিক্ষক নিয়োগের মতো স্পর্শকাতর জায়গায় জালিয়াতি শিক্ষাব্যবস্থার মেরুদণ্ডকেই ভেঙে দিচ্ছে। কুড়িগ্রামে যাচাইকৃত ১০৫ জন শিক্ষকের মধ্যে ৭৭ জনই ভুয়া শিক্ষক নিবন্ধন সনদ ব্যবহার করেছেন। সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয় হলো, বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ) কর্তৃক এদের সনদ জাল প্রমাণিত হওয়ার পরও ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ বাস্তবায়িত হয়নি; এই জাল সনদধারীরা নিয়মিত বেতন-ভাতা তুলে আসছেন 4। এই প্রাতিষ্ঠানিক অসহযোগীতার সংস্কৃতি অযোগ্যদের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণে সহায়তা করেছে।

নিয়োগে রাজনৈতিক ও আর্থিক জালিয়াতির সুনির্দিষ্ট প্রমাণও পাওয়া যায়। রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার আলীপুর মডেল কলেজে ২০০৩ সালে তৎকালীন প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার সভাপতিত্বে গঠিত নিয়োগ বোর্ডে নিয়ম ভেঙে সরকারি কলেজের বিশেষজ্ঞের পরিবর্তে বেসরকারি কলেজের প্রভাষকদের দ্বারা নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। এভাবে ১৬ জন শিক্ষককে অবৈধভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়। একই সঙ্গে, এই অবৈধ নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের এমপিও (মান্থলি পেমেন্ট অর্ডার) করা হয়েছে এক অবিশ্বাস্য জালিয়াতির মাধ্যমে—কলেজটি ২০১১ সালে একাডেমিক স্বীকৃতি পেলেও তার সাত বছর আগে, ২০০৪ সালেই কলেজটি এমপিও লাভ করে। এটি প্রমাণ করে যে অর্থ ও রাজনৈতিক প্রভাব প্রশাসনিক নিয়মকে সম্পূর্ণভাবে অকার্যকর করে দিয়েছে। এছাড়া, রাজশাহীর তানোরের লালপুর মডেল কলেজে দুজন সাবেক অধ্যক্ষের স্বাক্ষর জাল করে ২৩ বছর আগের তারিখে একজনকে নিয়োগ দেখিয়ে বেতন-ভাতা আত্মসাতের চেষ্টার মতো নজিরবিহীন ঘটনাও ঘটেছে।

৩.২. আর্থিক দুর্নীতি, সরবরাহ ও অবকাঠামো ব্যবস্থাপনা

শিক্ষা খাতের উচ্চপর্যায়ে আর্থিক দুর্নীতির অন্যতম বড় উদাহরণ হলো পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ। একটি সমীক্ষা অনুসারে, পাঠ্যপুস্তক তহবিলের ২০ শতাংশ থেকে ৬৫ শতাংশ পর্যন্ত ঘুষ বা পে-অফে চলে যায়। এই বিপুল পরিমাণ আত্মসাতের কারণে দেশের ৪০,০০০ সরকারি স্কুলে পাঠ্যপুস্তকের মারাত্মক ঘাটতি তৈরি হয়, যার ফলে ৬ জন থেকে ৮ জন শিক্ষার্থীকে একটি বই ভাগ করে নিতে হতো। এই আর্থিক দুর্নীতি সরাসরি সেবার মানকে প্রভাবিত করে এবং শিক্ষাকে একটি অ-সমতাভিত্তিক পণ্যে পরিণত করে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর (ডিআইএ) এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের জন্য ‘অডিট আতঙ্ক’ সৃষ্টি করেছে। ডিআইএ অডিট অফিসারের অবৈধ সম্পদের প্রাথমিক প্রমাণ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), যার মধ্যে এক কোটি টাকার সন্দেহজনক লেনদেন রয়েছে 15। অতীতে ঘুষের টাকাসহ কর্মকর্তা ধরা পড়লেও উল্লেখযোগ্য শাস্তি হয়নি; উল্টো অভিযোগকারী শিক্ষকরা হয়রানির শিকার হয়েছেন, এবং ঘুষের পরিমাণ বেড়েছে। ফলস্বরূপ, শিক্ষকরা আর তথ্য-প্রমাণসহ অভিযোগ জমা দিতে চান না 15। এছাড়া, তিনটি শিক্ষা বোর্ডের অডিটে গিয়ে ৩৯ লাখ টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে, যা অডিট টিমের স্বজনের ব্যাংক হিসাবে জমা হয়েছিল।

৩.৩. একাডেমিক ইন্টিগ্রিটির পতন এবং মেরিট ব্যবস্থার ধ্বংস

দুর্নীতির কারণে একাডেমিক ইন্টিগ্রিটির চরম পতন ঘটেছে। ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে প্রশ্নপত্র ফাঁস একটি মারাত্মক শিক্ষাবিরোধী অপরাধ, যেখানে শিক্ষকদের জড়িত থাকার ঘটনাও দেখা গেছে। ক্লাসে না পড়িয়ে প্রাইভেট টিউশনি বা কোচিং সেন্টারে পাঠদান এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দলীয় বিবেচনায় অযোগ্যদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া—এই সব কিছুই শিক্ষার গুণগত মানকে খর্ব করে। এই পরিস্থিতিতে সমাজে এমন একটি বার্তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, ‘ধনী সন্তানদের ভালো ফল করার দরকার নেই, তাদের বাবা-মায়ের অর্থই সাফল্যের গ্যারান্টি দেবে’। এই ব্যবস্থা মেধাভিত্তিক প্রতিযোগিতা ও সামাজিক গতিশীলতাকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেয়।

Cheif Editor of Zonota News

৪. প্রাতিষ্ঠানিক অসহযোগীতা: বিচারহীনতা ও দুর্বল জবাবদিহিতা

প্রাতিষ্ঠানিক অসহযোগীতা হলো দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বা আইন প্রয়োগে প্রশাসনের ইচ্ছাকৃত ব্যর্থতা, যা বিচারহীনতার সংস্কৃতি তৈরি করে এবং দুর্নীতিকে সুরক্ষা দেয়। এই অসহযোগীতা মূলত একটি ‘রাজনৈতিক ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা’ প্রক্রিয়া। যখন কোনো কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থায় দুর্নীতি লালিত হয়, তখন প্রশাসনিক সংস্থাগুলো রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বা ক্ষমতাধর দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কার্যকরভাবে ‘অসহযোগী’ হয়ে ওঠে।

৪.১. আইনি প্রক্রিয়ায় প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতা ও বিচারহীনতা

পাবলিক পরীক্ষা (অপরাধ) আইনে বা আইসিটি আইনে প্রশ্নপত্র ফাঁসের মতো গুরুতর অপরাধের মামলাগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রপক্ষ প্রমাণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে, যার ফলস্বরূপ ঢাকার সিএমএম আদালতে করা মামলাগুলোর প্রায় ৯৮ শতাংশ টেকেনি বা আসামিরা খালাস পেয়েছেন। এর মূল কারণ হলো দুর্বল তদন্ত এবং প্রসিকিউশন—রাষ্ট্রপক্ষ পর্যাপ্ত সাক্ষী বা জব্দ করা আলামত আদালতে উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হচ্ছে। এই নিষ্ক্রিয়তা আইনি ব্যবস্থাকে অবজ্ঞা করার সংস্কৃতি তৈরি করে।

দুর্নীতি প্রতিরোধের লক্ষ্যে ‘দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪’ প্রণীত হলেও, রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও আমলাতান্ত্রিক নিষ্ক্রিয়তার কারণে এর প্রয়োগ সীমিত। জাল সনদধারী শিক্ষকের বেতন বন্ধ না করা বা ঘুষের প্রমাণ পাওয়া অডিট কর্মকর্তার শাস্তি না হওয়া 15 প্রমাণ করে যে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের চেয়ে দুর্নীতিকে বাঁচিয়ে রাখাটাই প্রশাসনিক অগ্রাধিকার। আমলাতন্ত্র তাদের বিবেচনামূলক ক্ষমতা ব্যবহার করে দুর্নীতির সুযোগ তৈরি করে (রেন্ট সিকিং) এবং দুর্বল আইনি কাঠামো এই দুর্নীতিবাজ আমলাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।

৪.২. টিআইবি’র জাতীয় খানা জরিপ ২০২৩ অনুসারে দুর্নীতির আর্থিক চিত্র

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর ‘সেবাখাতে দুর্নীতি জাতীয় খানা জরিপ ২০২৩’ অনুযায়ী, সার্বিকভাবে দুর্নীতির শিকার ৭০.৯ শতাংশ খানা। শিক্ষা (সরকারি ও এমপিওভুক্ত) খাতে প্রাক্কলিত মোট ঘুষের পরিমাণ ছিল ২১৩.৯ কোটি টাকা। এই পরিসংখ্যান প্রমাণ করে যে, যদিও শিক্ষা খাতে ঘুষের পরিমাণ ভূমি সেবা বা বিচারিক সেবার মতো উচ্চ নয়, তবে এটি জাতীয় বাজেটের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ (সংশোধিত বাজেটের ১.৪৩ শতাংশ) হিসেবে জনগণের উপর আর্থিক বোঝা চাপায়। এই তথ্য নিম্নরূপ টেবিল দ্বারা স্পষ্টভাবে উপস্থাপিত হলো:

টিআইবি জাতীয় খানা জরিপ ২০২৩ অনুসারে বিভিন্ন সেবাখাতে প্রাক্কলিত ঘুষের পরিমাণ

সেবা খাত প্রাক্কলিত মোট ঘুষের পরিমাণ (কোটি টাকা) সার্বিক ঘুষের পরিমাণের শতাংশ দুর্নীতির প্রকৃতি
ভূমি সেবা ১০,৯০২.৩ উচ্চ উচ্চ আর্থিক মূল্য, রেন্ট-সিকিং
বিচারিক সেবা ২,৫১৩.০ উচ্চ ন্যায়বিচার প্রাপ্তিতে বাধা ও সামাজিক প্রভাব
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা ২,৩৫৭.৬ উচ্চ ক্ষমতা ও ক্ষমতার অপব্যবহার
পাসপোর্ট ১,৫৭০.০ উচ্চ ডকুমেন্টেশনে উচ্চ হার ও জনভোগান্তি
শিক্ষা (সরকারি ও এমপিওভুক্ত) ২১৩.৯ নিম্ন থেকে মাঝারি উচ্চ ফ্রিকোয়েন্সি, দৈনন্দিন সেবা/নিয়োগে ঘুষ
মোট প্রাক্কলিত ঘুষ (জাতীয় প্রাক্কলন) ১০,৯০২.৩ জাতীয় বাজেটের ১.৪৩%

৫. দুর্নীতির আর্থ-সামাজিক প্রভাব ও মানবসম্পদ উন্নয়ন

৫.১. জাতীয় উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জন ব্যর্থতা এবং অর্থনৈতিক ক্ষতি

শিক্ষা খাতে দুর্নীতির কারণে জাতীয় উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে 1। যখন প্রকল্পের টাকা নিজেদের মধ্যে ভাগ-বণ্টন হয় বা অদক্ষতা বাড়ে (যেমন অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগ), তখন রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগের রিটার্ন কমে যায়। এই দুর্নীতির ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক ক্ষতি ভয়াবহ। বিশ্বব্যাংকের রিপোর্টে বলা হয়েছে, যদি বাংলাদেশ দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারত, তবে জনগণের মাথাপিছু আয় বর্তমানের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ করা সম্ভব হতো 1। অর্থাৎ, দুর্নীতি কেবল একটি সামাজিক সমস্যা নয়, বরং এটি একটি প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতা যা দেশের ভবিষ্যৎ স্মার্ট অর্থনীতির  পথে অন্তরায় সৃষ্টি করছে।

৫.২. সামাজিক ন্যায়বিচারের অভাব ও জন-আস্থাহীনতা

দুর্নীতি সমাজে ন্যায্যতা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় প্রধান অন্তরায়। যখন শিক্ষাব্যবস্থা অর্থের বিনিময়ে সাফল্যের নিশ্চয়তা দেয়, তখন দরিদ্র ও মেহনতী মানুষের মেধা ও প্রচেষ্টা মূল্যহীন হয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতি জনগণের মধ্যে ব্যাপক হতাশা সৃষ্টি করে, যা গণতন্ত্র ও রাষ্ট্রীয় প্রক্রিয়ার প্রতি তাদের আস্থা কমিয়ে দেয়। শিক্ষা খাতে বিনিয়োগের ফলপ্রসূতা নির্ধারণ করে মানবসম্পদের গুণগত মান। কিন্তু যদি পাঠ্যপুস্তক তহবিল আত্মসাৎ হয় এবং অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগ পান, তবে এই বিনিয়োগের অধিকাংশই অপচয় হয়, যা জ্ঞানভিত্তিক জাতি গঠনে ব্যর্থতার দিকে ঠেলে দেয়।

৬. দুর্নীতি প্রতিরোধ ও উত্তরণের কৌশলগত সমাধান

শিক্ষা খাতে দুর্নীতি নির্মূলের জন্য একটি বহুমাত্রিক এবং কাঠামোগত পদ্ধতির প্রয়োজন, যা টিআইবি-এর সুপারিশ, আইনি সংস্কার এবং ডিজিটাল রূপান্তরের ওপর জোর দেবে।

৬.১. কাঠামোগত ও নীতিগত সংস্কার

দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে শক্তিশালী রাজনৈতিক অঙ্গীকার নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সরকারকে টিআইবি কর্তৃক প্রদত্ত ২০ দফা সুপারিশকে ভিত্তি ধরে কাঠামোগত সংস্কার শুরু করা যেতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ বাড়াতে হবে এবং প্রতিটি প্রকল্পের ব্যয়ের সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা ও নিয়মিত নিরপেক্ষ নিরীক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে। শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়াকে সম্পূর্ণ দলীয় প্রভাবমুক্ত করতে এনটিআরসিএ-এর মতো প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী ও স্বাধীন করতে হবে। নিয়োগ বোর্ডের সদস্যদের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে ডিজিটাল পদ্ধতির মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করা জরুরি। এছাড়া, পাঠ্যপুস্তক ব্যবস্থাপনা ও মান নিয়ন্ত্রণে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডকে (এনসিটিবি) কার্যকর স্বায়ত্তশাসন এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে একটি অধিদপ্তরকে এই এক্তিয়ার হস্তান্তর কোনো সমাধান না হয়।

৬.২. আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার

আইনের প্রাধান্য নিশ্চিত করে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত এবং সম্পূর্ণরূপে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। প্রশ্নপত্র ফাঁস ও জালিয়াতির মতো অপরাধের ক্ষেত্রে মামলা তদন্ত, সাক্ষ্যগ্রহণ ও আলামত উপস্থাপনের দুর্বলতা দূর করতে বিশেষ প্রশিক্ষিত প্রসিকিউশন দল গঠন করা উচিত, যাতে অপরাধীরা শাস্তি পায়। কারণ, যদি ঘুষ দিয়ে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষক নিয়মিত বেতন তুলতে পারেন, তবে শত চেষ্টা করেও সমাজের মধ্যে সততা প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব। পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) মতো প্রতিষ্ঠানগুলোতে দুর্নীতি বন্ধ করতে ‘হাদিয়া সংস্কৃতি’ চিরতরে বন্ধ করার জন্য কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। ঘুষের টাকাসহ ধরা পড়া কর্মকর্তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হলে অভিযোগকারী শিক্ষকরা হয়রানির শিকার হবেন না এবং এই খাতে স্বচ্ছতা বাড়বে।

৬.৩. নৈতিক মূল্যবোধ ও ডিজিটাল রূপান্তর

ব্যক্তির চরিত্র ও মনন গঠনে শৈশব ও কৈশোরে নৈতিক মূল্যবোধের সঠিক ও পর্যাপ্ত শিক্ষা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। শিক্ষকদের অবশ্যই আদর্শ হিসেবে নিজেদের নীতিবোধসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। দুর্নীতি দমন কমিশনের ‘সততা সংঘ’ কার্যক্রমের মাধ্যমে মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও মাদ্রাসার ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের মধ্যে সততা ও দুর্নীতি প্রতিরোধের সক্ষমতা তৈরি করা যেতে পারে।

পাশাপাশি, প্রযুক্তি ব্যবহার করে শিক্ষাব্যবস্থাকে ডিজিটাল রূপান্তর করা আবশ্যক। এর মধ্যে রয়েছে শিক্ষকের উপস্থিতি, ক্লাসের মান পর্যবেক্ষণ, এবং এমপিও প্রক্রিয়াকে সম্পূর্ণ অনলাইন প্ল্যাটফর্মে স্বচ্ছভাবে পরিচালনা করা। ডিজিটাল রূপান্তরের পথে প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা (বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট) মোকাবিলায় সরকারি-বেসরকারি সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে, এবং শিক্ষক, এসএমসি ও অভিভাবকদের পুরাতন ধ্যানধারণা পরিবর্তনের জন্য নিয়মিত মতবিনিময় সভার আয়োজন করতে হবে। ফিনল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরের মতো সফল কেস স্টাডি থেকে শিক্ষা নিয়ে রোডম্যাপ প্রণয়ন করা যেতে পারে।

৭. উপসংহার: টেকসই শিক্ষা ব্যবস্থার পথে সুপারিশমালা

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় জেঁকে বসা দুর্নীতি এবং প্রাতিষ্ঠানিক অসহযোগীতা নিরসনে দ্রুত, সমন্বিত এবং রাজনৈতিকভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ পদক্ষেপ অপরিহার্য। শিক্ষক নিয়োগে জালিয়াতি রোধ, আর্থিক লেনদেনে ডিজিটাল স্বচ্ছতা এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, অপরাধীদের বিরুদ্ধে বিচারিক প্রক্রিয়ায় কার্যকর ফল নিশ্চিত করা ছাড়া এই ক্ষত সারানো সম্ভব নয়।

টেকসই সমাধানের জন্য কেবল নৈতিক মূল্যবোধ বা প্রযুক্তি যথেষ্ট নয়; প্রয়োজন আইনি প্রয়োগ এবং প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতি পরিবর্তন। দুর্নীতির মূলোৎপাটনে রাষ্ট্র ও সমাজের মূল কাঠামোগত দুর্বলতাগুলোর সমাধান জরুরি। যদি দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তবে জাতীয় উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে এবং বিশ্বব্যাংকের বিশ্লেষণ অনুযায়ী মাথাপিছু আয় দ্বিগুণ করার স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নেবে। এখনই উপযুক্ত নীতি ও শিক্ষায় রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ এবং শক্তিশালী জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা সময়ের প্রধান চ্যালেঞ্জ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *