প্রাথমিক শিক্ষক: বেতন, মর্যাদা, কর্তব্য

বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন, মর্যাদা ও দায়িত্ব বিশ্লেষণ—জাতীয় শিক্ষার ভিত্তিমূলে পরিবর্তন আবশ্যক

(প্রতিবেদক: জে এইচ সুমন, জনতা নিউজ)

(প্রাথমিক শিক্ষক বেতন বৃদ্ধি, প্রাথমিক শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা, সহকারী শিক্ষক গ্রেড, প্রধান শিক্ষক গ্রেড, শিক্ষকদের অতিরিক্ত কাজের চাপ, প্রাথমিক শিক্ষা সংস্কার)

 

প্রথম পর্ব: প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ

১.১. প্রাথমিক শিক্ষার ভিত্তি এবং জাতীয় অগ্রাধিকার

শিক্ষাকে জাতির মেরুদণ্ড হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়, আর প্রাথমিক শিক্ষকেরাই সেই মেরুদণ্ড তৈরির মূল কারিগর। শিশুদের শারীরিক, মানসিক, নৈতিক ও সামাজিক বিকাশ সাধন এবং উন্নত জীবনের স্বপ্ন দর্শনে উদ্বুদ্ধ করার মধ্য দিয়ে প্রাথমিক শিক্ষা একটি সুদূরপ্রসারী ভিত্তি তৈরি করে। বর্তমানে বাংলাদেশ সরকার ‘স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার দীক্ষা’ স্লোগানকে সামনে রেখে প্রাথমিক শিক্ষার স্তর থেকেই এই লক্ষ্য অর্জনের গুরুত্ব দিচ্ছে। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এর লক্ষ্য অনুযায়ী, প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হলেও এর বাস্তবায়ন এখনও ধীরগতিতে চলছে।

সরকারের উচ্চাকাঙ্ক্ষা হলো মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা এবং পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ও এসডিজির লক্ষ্য অর্জন করা। কিন্তু এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান—প্রাথমিক শিক্ষকদের জীবনমান, বেতন ও সামাজিক মর্যাদা—তা নিয়ে সন্তোষজনক পরিস্থিতি বিরাজ করছে না। বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, রাষ্ট্রের উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং শিক্ষকদের বাস্তব মূল্যায়নের মধ্যে একটি মৌলিক ব্যবধান বিদ্যমান। শিক্ষার গুণগত মান উন্নত করতে হলে কেবল অবকাঠামো বা কারিকুলাম পরিবর্তন যথেষ্ট নয়; এর মূল চাবিকাঠি হলো শিক্ষকদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন এবং পেশাগত প্রেরণা নিশ্চিত করা। শিক্ষকদের যদি অর্থনৈতিকভাবে তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীর সমান মূল্যায়ন করা হয়, তবে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার স্বপ্ন কেবল কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ থেকে যাবে।

দ্বিতীয় পর্ব: প্রাথমিক শিক্ষকদের বর্তমান বেতন কাঠামো ও আর্থিক বৈষম্য (বেতন কাঠামো: কেমন রয়েছে?)

২.১. গ্রেড বিভাজন: প্রধান শিক্ষক (১০ম) বনাম সহকারী শিক্ষক (১৩তম)

সরকারি প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন কাঠামো জাতীয় বেতন স্কেল, ২০১৫-এর ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়। সাম্প্রতিককালে আদালতের নির্দেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের বেতন জাতীয় বেতন স্কেলের ১০ম গ্রেডে উন্নীত করা হয়েছে। এই গ্রেড উন্নীতকরণের ফলে প্রধান শিক্ষকদের বেতন-ভাতা প্রদানে সরকারের বছরে প্রায় ৩৪৯ কোটি ৩৩ লাখ ৫১ হাজার ৬৪০ টাকা অতিরিক্ত ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে এই উন্নয়নের ফলে সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের (AUEO) সাথে প্রধান শিক্ষকের গ্রেড সমান্তরাল হওয়ায় প্রশাসনিক জটিলতা তৈরি হয়েছে।

অন্যদিকে, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা বর্তমানে ১৩তম গ্রেডে বেতন পান। ফলস্বরূপ, প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকের মধ্যে বেতনের পার্থক্য প্রায় ১৫ হাজার টাকায় পৌঁছেছে। এই উল্লম্ব বৈষম্য সহকারী শিক্ষকদের মধ্যে চরম অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে। অনেক সহকারী শিক্ষক একই শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও অন্যান্য সরকারি বিভাগের কর্মীদের তুলনায় নিম্ন গ্রেডে আটকে আছেন, যা পেশাগত হতাশার জন্ম দেয়। এই অভ্যন্তরীণ বৈষম্য শিক্ষকদের মধ্যে দলবদ্ধভাবে কাজ করার পরিবেশকে ক্ষুণ্ণ করে এবং প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করার পথে বড় বাধা সৃষ্টি করে।

২.২. আর্থিক সুবিধা ও জীবনযাত্রার চাপ

প্রাথমিক শিক্ষকদের জন্য নির্ধারিত আর্থিক সুবিধাগুলো বর্তমান জীবনযাত্রার মানের তুলনায় অত্যন্ত অপ্রতুল। শিক্ষকদের মাসিক চিকিৎসা ভাতা মাত্র ১,৫০০ টাকা (৬৫ বছরের ঊর্ধ্বে হলে ২,৫০০ টাকা)।

টিফিন ভাতার ক্ষেত্রে চরম দীনতা পরিলক্ষিত হয়। শিক্ষক সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে জাতীয় পে-কমিশনের কাছে জানানো হয়েছে যে, শিক্ষকদের দৈনিক টিফিন ভাতা মাত্র ৬ টাকা ৬৬ পয়সা। এই নামমাত্র ভাতা শিক্ষকদের প্রতি রাষ্ট্রের আর্থিক সম্মানের অভাবকেই প্রতীকীভাবে তুলে ধরে। এটি শিক্ষকদের ন্যূনতম জীবনযাত্রার মান বজায় রাখতেও সহায়তা করতে পারে না, যা তাদের হতাশাকে আরও বাড়িয়ে তোলে এবং শ্রেণিকক্ষে পেশাগত আগ্রহ হ্রাসের একটি অন্যতম কারণ।

তাছাড়া, ২০১৫ সালের পে-স্কেলের ৭(খ) অনুচ্ছেদের ভুল ব্যাখ্যার কারণে বহু শিক্ষক উচ্চতর গ্রেড সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন, যা নিরসনের জন্য তারা পে-কমিশনের সামনে দাবি উত্থাপন করেছেন।

২.৩. শিক্ষক আন্দোলন ও দাবি-দাওয়া

বেতন কাঠামোতে সৃষ্ট বৈষম্য এবং জীবনযাত্রার নিম্ন মানের প্রতিবাদে প্রাথমিক শিক্ষকরা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছেন 15। তাদের প্রধান দাবি হলো সহকারী শিক্ষকদের ১১তম গ্রেড বাস্তবায়ন করা।

জাতীয় পে-কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে শিক্ষক নেতারা বেতন কাঠামোতে আমূল সংস্কারের প্রস্তাব দিয়েছেন। তারা বিদ্যমান ২০টি গ্রেড কমিয়ে ১২টি করার এবং সর্বনিম্ন বেসিক বেতন ৩৫ হাজার টাকা ও সর্বোচ্চ ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা নির্ধারণের দাবি জানিয়েছেন। এছাড়াও, তারা চিকিৎসা ভাতা ১০ হাজার, শিক্ষা ভাতা ৫-১০ হাজার এবং বাড়িভাড়া ভাতা এলাকাভেদে ৬৫ থেকে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধির দাবি জানান। পে-কমিশনের চেয়ারম্যান ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, সহকারী শিক্ষকদের ১১তম গ্রেড বাস্তবায়নের সুযোগ সীমিত, যদি না সামগ্রিক ২০টি গ্রেড ভেঙে ১২টি করা হয়। এই বক্তব্য থেকে স্পষ্ট হয়, সহকারী শিক্ষকদের দাবিটি কেবল প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ারভুক্ত নয়, বরং এটি জাতীয় বেতন কাঠামোর বৃহত্তর নীতিগত সংস্কারের ওপর নির্ভরশীল। এই কাঠামোগত বাধা প্রাথমিক শিক্ষকদের মর্যাদার ইস্যুটিকে সরকারের সামগ্রিক নীতির একটি টেস্ট কেস হিসেবে দাঁড় করিয়েছে।

তৃতীয় পর্ব: প্রাথমিক শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা ও পেশাগত চিত্র (মর্যাদা: দীনতা ও হতাশা)

৩.১. সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি: ‘তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী’ হিসেবে মূল্যায়ন

শিক্ষকতা পেশার মর্যাদা সকল পেশার ঊর্ধ্বে হওয়া উচিত হলেও বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষকরা সমাজে প্রায়শই ‘তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী’ হিসেবে বিবেচিত হন। এই নিম্ন সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং দুর্বল বেতন কাঠামো মেধাবী ও উচ্চ ডিগ্রিধারী তরুণদের এই পেশা থেকে বিমুখ করছে।

যদি স্নাতক সম্পন্ন উচ্চ শিক্ষিত তরুণরা এই পেশায় আগ্রহ না দেখান অথবা নিয়োগের পর হতাশ হয়ে ভালো চাকরির খোঁজে পেশা পরিবর্তন করেন, তবে প্রাথমিক শিক্ষা আশানুরূপ অগ্রগতি লাভ করতে পারে না। মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য সরকার নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নসহ যে পদক্ষেপই নিক না কেন, যদি চূড়ান্ত মেধাবীদের ধরে রাখা না যায়, তবে শিক্ষার ভিত্তিকে দুর্বল করে দিচ্ছে। বেতন গ্রেডে আটকে থাকা এবং সামাজিক দীনতা শিক্ষকদের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি করে, যা শিক্ষার গুণগত মানের ওপর সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

৩.২. আন্তর্জাতিক মানদণ্ড ও বাংলাদেশের বৈপরীত্য

বিশ্বজুড়ে শিক্ষকদের মর্যাদার চিত্রটি বাংলাদেশের তুলনায় ভিন্ন। সমীক্ষায় দেখা গেছে, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান ও সিঙ্গাপুরের মতো দেশগুলোতে শিক্ষকদের অত্যন্ত উচ্চ মর্যাদা দেওয়া হয়। দক্ষিণ কোরিয়ায় শিক্ষকদের মন্ত্রীর সমান সম্মান এবং জাপানে বিশেষ আইনি সুরক্ষা রয়েছে।

শিক্ষকদের পেশাগত অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড নির্ধারণের জন্য ১৯৬৬ সালের ৫ অক্টোবর ফ্রান্সের প্যারিসে ইউনেস্কো এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) যৌথভাবে শিক্ষকদের মর্যাদা বিষয়ক সনদ (Recommendation) গ্রহণ করে। এই আন্তর্জাতিক মানদণ্ডটি নির্দেশ করে যে, শিক্ষকদের উচ্চ মর্যাদা কেবল ব্যক্তিগত সম্মান নয়; এটি একটি কার্যকর নীতিগত হাতিয়ার যা পেশায় সেরা মেধাকে আকর্ষণ ও ধরে রাখার গ্যারান্টি দেয়। বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের উচিত এই বৈশ্বিক মানদণ্ড অনুসরণ করে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনা এবং শিক্ষকদের জন্য সম্মানজনক বেতন ও গ্রেড নিশ্চিত করা।

৩.৩. প্রশাসনিক নজরদারি এবং শিক্ষকদের মানসিক চাপ

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর শিক্ষকদের পেশাগত কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের ওপর নজরদারি করার জন্য জেলা, বিভাগ ও অধিদপ্তর পর্যায়ে মনিটরিং টিম গঠন করেছে 22। যদিও সরকারি প্রতিষ্ঠানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার নির্দেশিকা অনুসরণ করা আবশ্যক, শিক্ষকদের এই অতিরিক্ত নজরদারি তাদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করতে পারে।

যখন শিক্ষকদের বেতন ও মর্যাদা নিয়ে অসন্তোষ চরম পর্যায়ে থাকে এবং তারা যৌক্তিক দাবিতে আন্দোলন করেন, তখন তাদের সামাজিক মাধ্যমে নজরদারির আওতায় আনা হলে পেশাগত উদ্বেগ প্রকাশের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হতে পারে। এই পরিস্থিতি শিক্ষকদের মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টি করে এবং হতাশাগ্রস্ত শিক্ষকদের নীরব থাকতে বাধ্য করে, যা সামগ্রিক পেশাগত পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর।

চতুর্থ পর্ব: দায়িত্ব ও কর্তব্য বিশ্লেষণ (দায়িত্বের ভার: পাঠদান বনাম প্রশাসন)

৪.১. শিক্ষকদের দাপ্তরিক ও একাডেমিক দায়িত্ব

প্রাথমিক শিক্ষকদের প্রধান দায়িত্ব হলো শিক্ষার্থীর সার্বিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা এবং মানসম্মত শিক্ষা প্রদানের জন্য পেশাগত জ্ঞান ও দক্ষতা বৃদ্ধি করা। প্রধান শিক্ষককে বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে এক বিশাল সংখ্যক একাডেমিক ও প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করতে হয়। এর মধ্যে রয়েছে বাৎসরিক পাঠ পরিকল্পনা প্রণয়ন, সাপ্তাহিক রুটিন তৈরি, স্কুলের যাবতীয় রেকর্ড ও রেজিস্টার সংরক্ষণ, অ্যাসেসমেন্ট ও ইভালুয়েশন প্রক্রিয়া তত্ত্বাবধান, এবং স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন। সম্প্রতি স্লিপ (SLIP) ফান্ডে বরাদ্দ বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রধান শিক্ষকের প্রশাসনিক ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে।

৪.২. পাঠদান বহির্ভূত কাজের অত্যধিক চাপ

শিক্ষকদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো পাঠদান বহির্ভূত অতিরিক্ত কাজের চাপ। শিক্ষকরা শিক্ষকতার মূল কাজ বাদ দিয়ে নানা ধরনের কাজে নিয়োজিত হতে বাধ্য হচ্ছেন। শিক্ষা প্রশাসনের বাইরের অন্যান্য মন্ত্রণালয়গুলো শিক্ষকদের একটি সহজলভ্য ও প্রশিক্ষিত জনবল হিসেবে ব্যবহার করে। এই অতিরিক্ত কাজের ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য:

  • নির্বাচন কার্যক্রমে অংশগ্রহণ, ভোটার তালিকা প্রণয়ন ও হালনাগাদ।
  • বিভিন্ন শুমারি ও জরিপ (শিশু জরিপ, আদমশুমারি, কৃষিশুমারি, ল্যাট্রিন শুমারি)।
  • স্বাস্থ্য বিভাগের কাজ যেমন কৃমির ট্যাবলেট ও ভিটামিন-এ ক্যাপসুল বিতরণ।
  • বিদ্যালয়ের দপ্তরি কাম নিরাপত্তা প্রহরী ও অফিস সহায়ক পদ শূন্য থাকায় দাপ্তরিক ও করণিক কাজ করা।

৪.৩. শিক্ষার উপর নেতিবাচক প্রভাব ও শিখন ঘাটতি

এই অতিরিক্ত কাজের চাপের কারণে শিক্ষকদের শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে সরাসরি ব্যাঘাত ঘটে। এটি শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করার সরকারি উদ্যোগকে সরাসরি দুর্বল করে দিচ্ছে। জরিপে অংশগ্রহণকারী শিক্ষকদের মধ্যে ৫১ শতাংশ জানিয়েছেন যে, বাইরের কাজের চাপে ওই সময় ক্লাস নেওয়া সম্ভব হয় না। ৩৪ শতাংশ শিক্ষক অন্য শিক্ষক দিয়ে ক্লাস করালেও ১৫ শতাংশ শিক্ষক মনে করেন, বিকল্প শিক্ষক ক্লাস নিলেও শিক্ষার্থীদের শিখনে তা কার্যকর হয় না।

প্রাথমিক শিক্ষকদের অতিরিক্ত কাজে ব্যবহার করার এই দ্বৈত নীতি সরকারের জন্য দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি বয়ে আনছে। যদিও সরকার ঘোষণা করে যে শিক্ষা একটি অগ্রাধিকার, তবে শিক্ষকদের সস্তা ‘শ্রমিক’ হিসেবে অন্যান্য জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যবহার করা হয়। এই অতিরিক্ত কাজের ফলে সৃষ্ট শিখন ঘাটতি (Learning Loss) এবং অদক্ষ জনশক্তি তৈরি হওয়ার আর্থিক ও সামাজিক ক্ষতি (Opportunity Cost) প্রধান শিক্ষকের গ্রেড বৃদ্ধির অতিরিক্ত ব্যয়ের চেয়ে অনেক বেশি। শিক্ষকের এই অতিরিক্ত কাজের চাপকে অবিলম্বে ‘শিখন-ঘাটতির কারণ’ হিসেবে চিহ্নিত করে বন্ধ করা আবশ্যক।

শিক্ষকদের পাঠদান বহির্ভূত প্রধান দায়িত্বসমূহ ও শিক্ষার ওপর নেতিবাচক প্রভাব

দায়িত্বের ক্ষেত্র (পাঠদান বহির্ভূত) উদাহরণ শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের ওপর প্রভাব সূত্র
শুমারি ও জরিপ কার্যক্রম আদমশুমারি, কৃষিশুমারি, শিশু জরিপ ক্লাসরুম সময় হ্রাস, শিখন ঘাটতি তৈরি 13
প্রশাসনিক ও করণিক কার্যাবলী উপবৃত্তি তালিকা প্রণয়ন, রেজিস্ট্রার হালনাগাদ, অফিসিয়াল রিপোর্ট, দপ্তরির কাজ প্রধান শিক্ষক সারাক্ষণ প্রশাসনেই ব্যস্ত, পাঠদান পর্যবেক্ষণ ব্যাহত 13
স্বাস্থ্য ও অন্যান্য কর্মসূচি কৃমির ট্যাবলেট বিতরণ, ভিটামিন-এ ক্যাপসুল খাওয়ানো শিক্ষকদের পাঠদানে মনোযোগ কমে, সময়ের অপচয় 25

পঞ্চম পর্ব: প্রাথমিক শিক্ষা সংস্কার ও আদর্শ কাঠামো (কেমন হওয়া উচিৎ: নীতিগত সুপারিশ)

মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য শিক্ষকদের বেতন, মর্যাদা ও দায়িত্বের ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন আনা অপরিহার্য। শিক্ষকদের পেশাগত অগ্রগতির জন্য ড. মনজুর আহমেদ-এর নেতৃত্বে গঠিত পরামর্শক কমিটির সুপারিশমালা বাস্তবায়ন করা একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হতে পারে।

৫.১. ড. মনজুর আহমেদ কমিটির সুপারিশমালা: পদবি ও গ্রেড সংস্কার

কমিটি শিক্ষকদের বিশেষ মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য দীর্ঘমেয়াদে একটি স্বতন্ত্র এবং উচ্চতর বেতন কাঠামো প্রবর্তনের প্রস্তাব করেছে। অন্তর্বর্তী পদক্ষেপ হিসেবে পদবি ও গ্রেড সংস্কারের মাধ্যমে শিক্ষকদের পেশাগত অগ্রগতির একটি পরিষ্কার ধাপ তৈরি করার প্রস্তাব করা হয়েছে:

  1. শিক্ষকের স্বতন্ত্র নাম: ‘সহকারী শিক্ষক’ পদবি বিলুপ্ত করে পদটিকে কেবল ‘শিক্ষক’ নামে ১২তম গ্রেডে উন্নীত করা।
  2. সিনিয়র শিক্ষক পদে পদোন্নতি: চাকরিতে যোগদানের চার বছর পর সকল শিক্ষককে ‘সিনিয়র শিক্ষক’ (১১তম গ্রেড) পদে পদোন্নতি দেওয়া। এই ধাপটি সহকারী শিক্ষকদের দীর্ঘদিনের ১১তম গ্রেডের দাবি পূরণে সহায়ক হবে।
  3. সহকারী প্রধান শিক্ষক পদ: ৯,৫৭২টি ‘সহকারী প্রধান শিক্ষক’ পদ সৃষ্টির প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে সিনিয়র শিক্ষকদের মধ্যে থেকে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে তাদের পদোন্নতি নিশ্চিত করা (১১তম গ্রেড)।
  4. প্রধান শিক্ষকের গ্রেড নিশ্চিতকরণ: প্রধান শিক্ষক পদটি ১০ম গ্রেডভুক্ত নিশ্চিত করা এবং এই পদে পদোন্নতির জন্য সিনিয়র শিক্ষক/সহকারী প্রধান শিক্ষক পদ থেকে অন্যূন ৭ (সাত) বছরের অভিজ্ঞতা নির্ধারণ করা।

এই সুপারিশমালা বাস্তবায়িত হলে প্রাথমিক শিক্ষকতায় একটি স্পষ্ট পেশাগত অগ্রগতি দেখা দেবে, যা শিক্ষকদের মধ্যে পেশার প্রতি আগ্রহ ও আত্মমর্যাদা ফিরিয়ে আনবে।

প্রাথমিক শিক্ষকদের বর্তমান ও প্রস্তাবিত গ্রেড এবং পদবি তুলনা

বর্তমান পদবি (প্রচলিত) বর্তমান গ্রেড (২০১৫ স্কেল) ড. মনজুর কমিটির প্রস্তাবনা (ফেব্রুয়ারি ২০২৫) প্রস্তাবিত গ্রেড সূত্র
সহকারী শিক্ষক ১৩তম/১৪তম/১৫তম শিক্ষক (সহকারী শিক্ষক পদবি বিলুপ্ত) ১২তম 8
সিনিয়র শিক্ষক (প্রযোজ্য নয়) সিনিয়র শিক্ষক (৪ বছর চাকরির পর) ১১তম 26
সহকারী প্রধান শিক্ষক (সৃজন প্রক্রিয়াধীন) ১১তম/১২তম (অপ্রশিক্ষিত) সহকারী প্রধান শিক্ষক (পদোন্নতি ভিত্তিক) ১১তম 26
প্রধান শিক্ষক ১০ম (উচ্চ আদালতের নির্দেশে) প্রধান শিক্ষক ১০ম 8

৫.২. বেতন ও ভাতা বৃদ্ধি এবং জীবনের মান উন্নয়ন

শিক্ষকদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে হলে জাতীয় পে-কমিশনের কাছে উত্থাপিত সর্বনিম্ন বেসিক বেতন ৩৫ হাজার টাকায় উন্নীত করার প্রস্তাব গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা উচিত। নামমাত্র ৬ টাকা ৬৬ পয়সার দৈনিক টিফিন ভাতা অবিলম্বে যৌক্তিক হারে বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। চিকিৎসা ভাতা, শিক্ষা ভাতা এবং বাড়িভাড়া ভাতা বৃদ্ধি করে শিক্ষকদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আবশ্যক। বিশেষ করে, গ্রামীণ ও মফস্বল পর্যায়ে কর্মরত শিক্ষকদের জন্য যাতায়াত ভাতা চালুর দাবি বিবেচনা করা উচিত, যা বর্তমানে কেবল সিটি করপোরেশন এলাকায় সীমাবদ্ধ।

৫.৩. দায়িত্বের পুনর্বিন্যাস: শিক্ষকতার কাজে স্বাধীনতা

শিক্ষকদের কেবল নির্বাচনের কাজ ব্যতীত সকল প্রকার শুমারি, জরিপ, স্বাস্থ্য ও প্রশাসনিক কার্যাবলি থেকে অব্যাহতি দেওয়া উচিত। শিক্ষকতাকে জাতীয় উন্নয়নে সবচেয়ে মূল্যবান বিনিয়োগ হিসেবে দেখতে হবে। এই অতিরিক্ত কাজের চাপ বন্ধ করার জন্য সরকারকে অন্যান্য মন্ত্রণালয়ে প্রেরিত অনুরোধ কার্যকর করতে হবে। বিদ্যালয়ের দাপ্তরিক ও করণিক কাজ এবং নিরাপত্তা প্রহরা নিশ্চিত করার জন্য অবিলম্বে স্থায়ী জনবল নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন।

ষষ্ঠ পর্ব: গভীর বিশ্লেষণ ও নীতিগত প্রভাব

প্রাথমিক শিক্ষকদের বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বেতন এবং মর্যাদার ইস্যুটি কেবল আর্থিক অসন্তোষ নয়, বরং শিক্ষার গুণগত মানের ওপর সুদূরপ্রসারী মনো-সামাজিক প্রভাব ফেলছে।

৬.১. গ্রেড বৈষম্যের দীর্ঘমেয়াদী মনো-সামাজিক প্রভাব

প্রধান শিক্ষক এবং সহকারী শিক্ষকের মধ্যে প্রায় ১৫ হাজার টাকার বেতন বৈষম্য এবং একই শিক্ষাগত যোগ্যতায় অন্য সরকারি চাকুরেরা উচ্চ গ্রেড পাওয়ায় প্রাথমিক শিক্ষকতা পেশাটি একটি ‘ডেড-এন্ড’ চাকরি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে। এই গ্রেড বৈষম্য কর্মীদের মধ্যে তীব্র হতাশা এবং নিম্ন মনোবল সৃষ্টি করে। যখন কর্মীরা তাদের পেশাগত ভূমিকায় অবমূল্যায়িত হন, তখন এটি শ্রেণিকক্ষের উদ্দীপনা এবং শিক্ষার্থীর প্রতি শিক্ষকের মনোযোগে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এই চক্র ভাঙার জন্য ড. মনজুর কমিটির প্রস্তাবিত সুস্পষ্ট পেশাগত অগ্রগতির ধাপগুলো (শিক্ষক $\rightarrow$ সিনিয়র শিক্ষক $\rightarrow$ সহকারী প্রধান শিক্ষক $\rightarrow$ প্রধান শিক্ষক) অবিলম্বে বাস্তবায়ন করা অত্যাবশ্যক।

৬.২. প্রশাসনিক অতি-নিয়ন্ত্রণের ঝুঁকি

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর কর্তৃক সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের ওপর নজরদারি কমিটি গঠন করা 22 শিক্ষকদের পেশাগত নিয়ন্ত্রণের মাত্রাতিরিক্ত প্রবণতা নির্দেশ করে। যখন শিক্ষকের বেতন ও মর্যাদা নিয়ে অসন্তোষ ও আন্দোলন চরম পর্যায়ে থাকে, তখন মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হলে নিম্ন মনোবল আরও বাড়ে। এটি একটি দমনমূলক পরিবেশ তৈরি করে, যেখানে শিক্ষকরা তাদের যৌক্তিক দাবি বা সমালোচনা প্রকাশ করতে নিরুৎসাহিত হন। এই পরিস্থিতি সমস্যা সমাধানের পরিবর্তে কেবল শিক্ষকদের মধ্যেকার হতাশাটিকে আরও গভীরে নিয়ে যেতে পারে।

৬.৩. বিনিয়োগ বনাম খরচ: অতিরিক্ত কাজের ক্ষেত্রে দ্বৈত নীতি

শিক্ষকদের পাঠদান বহির্ভূত কাজে ব্যবহার করার পেছনে সরকারের দ্বৈত নীতি কাজ করে। একদিকে সরকার মানসম্মত শিক্ষার কথা বলে, অন্যদিকে শিক্ষকদের অন্যান্য জনকল্যাণমূলক কাজে সস্তা ‘শ্রমিক’ হিসেবে ব্যবহার করে। জরিপে দেখা গেছে, এই অতিরিক্ত কাজের কারণে ৫১ শতাংশ ক্লাসে ক্ষতি হয়, যা শিখন ঘাটতির জন্ম দেয়। এই শিখন ঘাটতির ফলে অদক্ষ জনশক্তি তৈরি হয়, যার দীর্ঘমেয়াদী নেতিবাচক প্রভাব জাতীয় উৎপাদনশীলতার ওপর পড়ে। শিক্ষা খাতে শিক্ষকদের সময়কে জাতীয় উন্নয়নে সবচেয়ে মূল্যবান বিনিয়োগ হিসেবে দেখতে হবে এবং তাদের কেবলমাত্র পঠন-পাঠন সংশ্লিষ্ট কাজে নিয়োজিত রাখা আবশ্যক।

সপ্তম পর্ব: উপসংহার ও চূড়ান্ত প্রস্তাবনা

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন, সামাজিক মর্যাদা এবং দায়িত্বের বর্তমান অবস্থা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, দেশের শিক্ষার ভিত্তি চরম সংকটের মুখে রয়েছে। জাতির মেরুদণ্ড তৈরির এই কারিগররা বেতন বৈষম্য (১০ম বনাম ১৩তম গ্রেড), সামাজিক দীনতা এবং শ্রেণিকক্ষের বাইরে অতিরিক্ত কাজের ভারে জর্জরিত। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সমন্বিত এবং আমূল সংস্কার প্রয়োজন।

চূড়ান্ত প্রস্তাবনা:

  1. গ্রেড বৈষম্য নিরসন ও স্বতন্ত্র পেশাগত ধারা সৃষ্টি: ড. মনজুর আহমেদ কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী, সহকারী শিক্ষকদের পদবি ‘শিক্ষক’ নামে ১২তম গ্রেডে এবং ৪ বছর পর ‘সিনিয়র শিক্ষক’ নামে ১১তম গ্রেডে উন্নীত করা। প্রধান শিক্ষকদের ১০ম গ্রেড নিশ্চিত করে শিক্ষার মানোন্নয়নকে পেশাগত অগ্রগতির সাথে যুক্ত করা।
  2. আর্থিক সম্মান পুনরুদ্ধার: শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোর লক্ষ্য নির্ধারণ করা। দৈনিক টিফিন ভাতা, চিকিৎসা ভাতা এবং বাড়িভাড়া ভাতা বৃদ্ধি করে ন্যূনতম জীবনধারণের ব্যয় নিশ্চিত করা। শিক্ষকদের জন্য ন্যূনতম বেসিক বেতন ৩৫ হাজার টাকায় উন্নীত করার প্রস্তাব গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত।
  3. দায়িত্বের যৌক্তিক পুনর্বিন্যাস: নির্বাচন সংক্রান্ত কাজ ব্যতীত সকল প্রকার শুমারি, জরিপ, স্বাস্থ্য কার্যক্রম ও অতিরিক্ত প্রশাসনিক কার্যাবলি থেকে শিক্ষকদের সম্পূর্ণভাবে অব্যাহতি দেওয়া। বিদ্যালয়ের দাপ্তরিক ও প্রশাসনিক সহায়তার জন্য অবিলম্বে পর্যাপ্ত জনবল নিয়োগ করা।
  4. পেশাগত মর্যাদা প্রতিষ্ঠা: ১৯৬৬ সালের ইউনেস্কো/আইএলও সনদ অনুসরণ করে প্রাথমিক শিক্ষকতাকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মানিত পেশার কাতারে উন্নীত করার জন্য নীতিগত ও সামাজিক উদ্যোগ গ্রহণ করা, যাতে সমাজের মেধাবী তরুণরা এই পেশায় আকৃষ্ট হন।

শিক্ষক সমাজকে তাদের ন্যায্য মর্যাদা, উন্নত জীবনমান এবং নিরবচ্ছিন্ন পাঠদানের পরিবেশ ফিরিয়ে দিলেই কেবল বাংলাদেশে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষার ভিত্তি মজবুত হবে এবং ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *