ইমামদের বেতন, মর্যাদা ও কর্তব্য

বাংলাদেশের মসজিদের ইমামগণ: বেতন বৈষম্য থেকে জাতীয় মর্যাদা; বর্তমান প্রেক্ষাপট, নতুন নীতি ও সামাজিক রূপান্তর

ক. ভূমিকা: শতাব্দীর অবহেলিত নেতৃত্ব

বাংলাদেশের সামাজিক ও ধর্মীয় কাঠামোর কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করেন মসজিদের সম্মানিত ইমামগণ। তাঁরা শুধু ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্বই পালন করেন না, বরং সমাজের নৈতিক দিকনির্দেশক, শিক্ষাবিদ এবং স্থানীয় নেতা হিসেবেও ভূমিকা রাখেন। সমাজের ভিত্তি হিসেবে মসজিদ এবং ইমামের এই কেন্দ্রীয় অবস্থান সর্বজনস্বীকৃত। ধর্ম উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন এই ব্যক্তিত্বদের ‘সমাজের অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তিত্ব’ হিসেবে অভিহিত করেছেন ।   

তবে, এই উচ্চ সামাজিক প্রত্যাশা এবং মর্যাদার বিপরীতে, বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ ইমাম-মুয়াজ্জিন যুগ যুগ ধরে অর্থনৈতিক অবহেলা এবং আইনি সুরক্ষার অভাবে কঠিন জীবন যাপন করছেন । এটিই বর্তমান প্রেক্ষাপটের মূল দ্বন্দ্ব: সমাজ ইমামদের কাছ থেকে সর্বোচ্চ নৈতিকতা ও সামাজিক নেতৃত্ব আশা করে, কিন্তু তাদের আর্থিক ও আইনি সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। এই দ্বৈততা তাদের কার্যকর সামাজিক ভূমিকার পথে প্রধান বাধা হিসেবে কাজ করে। পিরোজপুর-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য প্রার্থী মাসুদ সাঈদী এই অর্থনৈতিক দূরাবস্থার কথা উল্লেখ করে বলেছেন যে, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও মূল্যবোধের অবক্ষয়ের বর্তমান প্রেক্ষাপটে নিতান্ত অল্প বেতনে ইমামগণের জীবন নির্বাহ করাই এখন দুঃস্কর ।   

এই ঐতিহাসিক অবহেলার পরিপ্রেক্ষিতে, সাম্প্রতিক অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ইমাম-মুয়াজ্জিনদের জন্য একটি নতুন বেতন স্কেল এবং আইনি কাঠামো তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে, যা একটি যুগান্তকারী পরিবর্তনের সূচনা করে । এই প্রতিবেদনটি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ইমামদের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা, সামাজিক মর্যাদা, এবং বহুমুখী দায়িত্বের গভীর বিশ্লেষণ করবে, পাশাপাশি আদর্শিক ও নীতিগত সংস্কারের পথরেখা তুলে ধরবে।   

খ. অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট: স্বল্প বেতন, কঠিন জীবন এবং নীতি সংস্কার

২.১. বর্তমান বাস্তবতা: নূন্যতম সম্মানী ও জীবন নির্বাহের চ্যালেঞ্জ

বাংলাদেশের অধিকাংশ মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিনদের জন্য কোনো নির্দিষ্ট জাতীয় বেতন স্কেল বা চাকরি নীতিমালা নেই । তাদের আয় মূলত মসজিদ কমিটির অনুদান বা স্থানীয় পৃষ্ঠপোষকদের দেওয়া সম্মানী, যা প্রায়শই অনিয়মিত এবং অপ্রতুল। এই অনিয়মিত আয়ের কারণে তাদের পেশাগত জীবনে চরম অনিশ্চয়তা বিরাজ করে। সমাজের স্তম্ভ হিসেবে বিবেচিত হওয়া সত্ত্বেও, তাদের হাতে জীবন নির্বাহের জন্য পর্যাপ্ত বেতন না থাকায়, বহু ইমামকে দ্বিতীয় পেশা গ্রহণ করতে হয়, যা তাদের মূল দায়িত্ব পালনে মনোযোগ ব্যাহত করে।   

অর্থনৈতিক নিরাপত্তার অভাব পূরণের প্রাথমিক প্রচেষ্টা হিসেবে সরকার ২০০১ সালে ইমাম-মুয়াজ্জিন কল্যাণ ট্রাস্ট আইন পাস করে । এই ট্রাস্টের আওতায় মাসিক চাঁদা (যেমন ১০ টাকা) পরিশোধের মাধ্যমে ইমাম ও মুয়াজ্জিনগণ সদস্যভুক্ত হতে পারেন । যদিও এটি আর্থিক সহায়তার একটি প্রাথমিক কাঠামো তৈরি করে, কিন্তু সীমিত সুবিধার কারণে এটি বৃহৎ সংখ্যক ইমামের মৌলিক চাহিদা পূরণে পুরোপুরি সক্ষম হয়নি।   

২.২. যুগান্তকারী নীতি পরিবর্তন: প্রস্তাবিত জাতীয় বেতন স্কেল

ইমামদের দীর্ঘদিনের অর্থনৈতিক দুরবস্থা লাঘবে এবং পেশাটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়ার লক্ষ্যে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ধর্ম উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন ইমাম-মুয়াজ্জিনদের জন্য একটি নতুন বেতন কাঠামো খসড়া আকারে প্রস্তাব করেছেন । এই প্রস্তাবনাটি ধর্মীয় পেশাটিকে রাষ্ট্রের চোখে একটি আনুষ্ঠানিক বা ‘Professional’ কাজে রূপান্তরের একটি সুস্পষ্ট প্রচেষ্টা।   

প্রস্তাবিত পে স্কেলে সর্বোচ্চ দেড় লাখ টাকা এবং সর্বনিম্ন ২৫ হাজার টাকা নির্ধারণের কথা বলা হয়েছে । ড. খালিদ হোসেন জানিয়েছেন যে, দ্রুত সময়ের মধ্যে এই বেতন স্কেলটি তৈরি করে প্রধান উপদেষ্টার অনুমোদন নিয়ে গেজেট আকারে প্রকাশ করা হবে ।   

এই বেতন স্কেলের প্রস্তাবনা বাংলাদেশে ইমামদের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নিয়ে আসতে পারে। সর্বনিম্ন ২৫ হাজার টাকার প্রস্তাবটি গ্রামীণ এবং স্বল্প আয়ের ইমামদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে সাহায্য করবে। অন্যদিকে, সর্বোচ্চ দেড় লাখ টাকার প্রস্তাবটি মূলত বড় মসজিদ, উচ্চ শিক্ষিত খতিব বা ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রশিক্ষক পদে নিয়োজিত যোগ্য আলেমদের আকৃষ্ট করার লক্ষ্য রাখে। এই বৈষম্যমূলক বেতন কাঠামো ইমামতির পেশাকে পেশাদারিত্বের দিকে নিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত দেয়, যেখানে উচ্চতর বেতন পেতে হলে, ব্যক্তিকে অবশ্যই উচ্চতর শিক্ষাগত যোগ্যতা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করতে হবে।

নিম্নলিখিত সারণীতে প্রস্তাবিত অর্থনৈতিক কাঠামোর একটি বিশ্লেষণ উপস্থাপন করা হলো:

বাংলাদেশের ইমামদের প্রস্তাবিত বেতন স্কেল (অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কর্তৃক প্রস্তাবিত খসড়া)

পদবি/মানদণ্ড প্রস্তাবিত সর্বোচ্চ বেতন (BDT) প্রস্তাবিত সর্বনিম্ন বেতন (BDT) নীতিগত তাৎপর্য
উচ্চ শিক্ষিত/প্রধান ইমাম/খতিব ১,৫০,০০০+ পেশাদারিত্বের উচ্চ মান নির্ধারণ ও যোগ্য আলেমদের আকৃষ্ট করা ।
ইমাম/মুয়াজ্জিন (জাতীয় ন্যূনতম) ২৫,০০০ জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক অবহেলা দূরীকরণ ।
সূত্র: ধর্ম মন্ত্রণালয়ের খসড়া প্রস্তাব, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার (২০২৪/২০২৫)

  

২.৩. বেতন স্কেলের অর্থায়ন ও স্থায়িত্বের মডেল

বেতন স্কেল বাস্তবায়নের জন্য স্থিতিশীল অর্থায়ন একটি প্রধান চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একটি উদ্ভাবনী মডেলের পরিকল্পনা করেছে। ধর্ম উপদেষ্টা জানিয়েছেন যে, সরকার চাচ্ছে ব্যাংকে পড়ে থাকা টাকাগুলোকে ইউটিলাইজ করে ইমাম-মুয়াজ্জিনদের কল্যাণে কাজে লাগাতে ।   

এর পাশাপাশি, সরকার বাণিজ্যিক উদ্যোগের মাধ্যমে কল্যাণ ট্রাস্টের তহবিলকে স্বাবলম্বী করার পরিকল্পনা নিয়েছে। প্রাথমিকভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে একটি ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট করা হবে, সেখান থেকে মিনারেল ওয়াটার তৈরি করে বাজারে সরবরাহ করা হবে। এই লাভের অংশ ইমাম-মুয়াজ্জিনদের কল্যাণ ট্রাস্টে যাবে। পানির বোতলের নাম ‘ইমাম’ রাখার প্রাথমিক নিয়ত করা হয়েছে । এই পদক্ষেপ সরকারি অর্থের উপর নির্ভরতা কমানোর এবং কল্যাণ ট্রাস্টের জন্য একটি টেকসই রাজস্ব প্রবাহ নিশ্চিত করার দৃঢ় ইচ্ছার প্রকাশ। এই ধরনের বাণিজ্যিক মডেল নিশ্চিত করতে পারে যে অর্থায়নের জন্য ভবিষ্যতে “আর কারো কাছে টাকা চাইতে হবে না” ।   

গ. সামাজিক মর্যাদা ও আইনি নিরাপত্তা: বর্তমান অবহেলা এবং প্রত্যাশিত পরিবর্তন

৩.১. মর্যাদার সংকট ও আইনি সুরক্ষার অভাব

ধর্ম উপদেষ্টা কর্তৃক ইমামদেরকে ‘সমাজের অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তিত্ব’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হলেও , বাস্তবতা হলো আইনি কাঠামো ও চাকরির নীতিমালা না থাকায় তাদের মান-সম্মানের নিরাপত্তার অভাব রয়েছে । যেহেতু ইমামতির কোনো আনুষ্ঠানিক সার্ভিস রুল নেই, তাই স্থানীয় মসজিদ কমিটিগুলোর খেয়ালখুশি ও স্থানীয় রাজনীতির কারণে অনেক ইমামই চাকরি হারানোর বা হয়রানির ঝুঁকিতে থাকেন।   

ইসলামের দৃষ্টিতে ইমাম হচ্ছেন ‘জিম্মাদার’ এবং মুয়াজ্জিন হচ্ছেন ‘আমানতদার’ । এই জিম্মাদারি একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব, যার জন্য ইমামকে যেমন যোগ্য হতে হবে, তেমনি তাকে মহৎ গুণের অধিকারীও হতে হবে । কিন্তু এই মহান দায়িত্ব পালনের জন্য প্রয়োজনীয় আইনি ও পেশাগত সুরক্ষার অভাব তাদের কার্যকারিতা হ্রাস করে।   

৩.২. জাতীয় দাবি: সার্ভিস রুলস ও চাকরির নীতিমালা

ইমামদের সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা এবং চাকরির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জাতীয় পর্যায়ে একাধিক দাবি উঠেছে। প্রথিতযশা আলেমদের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করে দেশের সকল মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিনদের জন্য জাতীয় বেতন কাঠামো ও চাকরির নীতিমালা তৈরির জোর দাবি জানানো হয়েছে ।   

২০২৫ সালে অনুষ্ঠিতব্য সম্মিলিত ইমাম খতিব জাতীয় সম্মেলন বাস্তবায়ন কমিটির সভায় ইমামদের সামাজিক মূল্যায়ন ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা, ধর্মীয় দায়িত্ব পালনে স্বাধীনতা এবং তাদের জন্য সার্ভিস রুল নিয়োগবিধি প্রণয়নের দাবি উত্থাপন করা হয়েছে । এই দাবিগুলো প্রমাণ করে যে, শুধুমাত্র বেতন বৃদ্ধি নয়, বরং আইনি ভিত্তি স্থাপনই এখন ইমাম সমাজের প্রধান লক্ষ্য। যদি জাতীয় বেতন স্কেল বাস্তবায়ন করা হয়, তবে এর অনিবার্য ফলাফল হিসেবে একটি আনুষ্ঠানিক চাকরির নীতিমালা (Service Rule) প্রণয়ন করা বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়াবে। এটিই তাদের পেশাগত সুরক্ষা নিশ্চিত করবে।   

৩.৩. শিক্ষার মাধ্যমে মর্যাদা প্রতিষ্ঠা: দাওরায়ে হাদিস সনদের স্বীকৃতি

ইমামদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হলো তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতাকে রাষ্ট্রীয় মূলধারায় প্রতিষ্ঠা করা। আলেম সমাজ দাবি করেছে যে, দাওরায়ে হাদিস সনদপ্রাপ্ত ইমাম, খতিব ও আলেমগণকে স্কুল-কলেজে ধর্মীয় শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে এবং তাদের জন্য নির্দিষ্ট নিয়োগবিধি প্রণয়ন করতে হবে ।   

দাওরায়ে হাদিস সনদের স্বীকৃতি এবং এর ভিত্তিতে শিক্ষক নিয়োগের দাবি প্রমাণ করে যে, আলেমরা তাদের মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য ধর্মীয় শিক্ষাকে মূলধারার শিক্ষাব্যবস্থার সমতুল্য করার কৌশল অবলম্বন করছেন। এই রাষ্ট্রীয় ইন্টিগ্রেশন সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধিতে সবচেয়ে বড় অনুঘটক হবে। কারণ, যদি ধর্মীয় শিক্ষাকে আনুষ্ঠানিকভাবে পেশাগত যোগ্যতা হিসেবে গ্রহণ করা হয়, তবে মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থার গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পাবে এবং কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে একটি বড় ইতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি হবে।

ঘ. দায়িত্ব ও কর্তব্য: ঐতিহ্যবাহী ভূমিকা এবং আধুনিক সামাজিক রূপান্তর

ইমামের দায়িত্ব ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটি একটি বহুমুখী ভূমিকা, যা ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় নির্দেশনা এবং আধুনিক আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের মধ্যে একটি সেতু স্থাপন করে।

৪.১. ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় ও নৈতিক দায়িত্ব

ঐতিহ্যগতভাবে, ইমামের ভূমিকা হচ্ছে জাতির আমলগত সংস্কারের জিম্মাদার হওয়া । তিনি জনসাধারণকে ইসলামের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান দান করেন এবং তাদের আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য কর্মসূচি গ্রহণ করেন। ইমামদের প্রধান দায়িত্বের মধ্যে রয়েছে আক্বীদাগত সংস্কার ও দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করা, বাতিল আক্বীদা ও মতবাদকে খণ্ডন করা এবং ভ্রান্ত চিন্তাধারার মূলোৎপাটন করা ।   

মসজিদে নববীতে আখেরি নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা) আজীবন ইমামের দায়িত্ব পালন করে গেছেন। তিনি মসজিদকে শুধু নামাজের জন্য সীমাবদ্ধ রাখেননি, বরং সমাজ উন্নয়নের যাবতীয় কর্মকাণ্ডের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন । একজন সৎ, নিষ্ঠাবান, তাকওয়াধারী আল্লাহওয়ালা আলেম হিসেবে, ইমামকে অবশ্যই মানবতার পথপ্রদর্শক হতে হবে ।   

৪.২. ইসলামিক ফাউন্ডেশন ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সম্প্রসারিত দায়িত্ব

ইমামদের এই ঐতিহ্যবাহী ভূমিকা এখন রাষ্ট্রীয় জনকল্যাণমূলক কার্যক্রমের সাথে একীভূত হয়েছে। সরকার ১৯৭৯ সালে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের নিয়ন্ত্রণাধীন ইমাম প্রশিক্ষণ একাডেমি স্থাপন করে, যার মূল লক্ষ্য হলো প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ইমামদের দক্ষতা বৃদ্ধি করা এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সম্পৃক্ত করা ।   

এই প্রশিক্ষণে ইসলামের মৌলিক ধারণার পাশাপাশি বহু আধুনিক আর্থ-সামাজিক বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যেমন: কৃষি ও বনায়ন, প্রাণিসম্পদ ও মৎস্য চাষ , প্রাথমিক স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ, প্রাক-প্রাথমিক ও গণশিক্ষা, বিজ্ঞান, তথ্য ও প্রযুক্তি, পরিবেশ ও সামাজিক উন্নয়ন । এ পর্যন্ত সারা দেশে ১ লাখ ৯ হাজার ১৬৮ জনকে ৪৫ দিনের নিয়মিত প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে ।   

এই প্রশিক্ষণ মডিউলগুলি নির্দেশ করে যে রাষ্ট্র ইমামদের কেবল ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে, স্থানীয় অর্থনীতির মূল ধারক এবং সামাজিক সমস্যা সমাধানের এজেন্টে পরিণত করেছে। ইমাম প্রশিক্ষণ গ্রহণকারী ইমামগণ তাদের জ্ঞান কাজে লাগিয়ে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছেন এবং নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছেন ।   

৪.৩. জাতীয় নিরাপত্তা ও জনশিক্ষায় ইমামদের বিশাল অবদান

ইমামগণ বর্তমানে সমাজের প্রভাবশালী নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি হিসেবে রাষ্ট্রীয় জনকল্যাণমূলক কাজ পরিচালনা করছেন।

ক. সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ: ধর্ম প্রতিমন্ত্রী স্বীকার করেছেন যে, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও মাদকাসক্তি দমনে ইসলামিক ফাউন্ডেশন ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ইমামগণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন । প্রশিক্ষিত ইমামগণ মসজিদে জুমার বয়ানসহ ধর্মীয় ও সামাজিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বক্তব্য প্রদান করে মানুষকে ইতিবাচক কাজে উদ্বুদ্ধ করছেন ।   

খ. জনশিক্ষা ও নিরক্ষরতা দূরীকরণ: মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রম ইসলামিক ফাউন্ডেশনের একটি অন্যতম বৃহৎ প্রকল্প, যা ১৯৯৩ সালে শুরু হয় । এই প্রকল্পের আওতায় ইমামগণ মসজিদ কেন্দ্রে শিশু ও বয়স্ক শিক্ষার্থীদেরকে বাংলা, অংক, ইংরেজি, আরবী, নৈতিকতা ও মূল্যবোধসহ বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা দান করেন । এই শিক্ষা কার্যক্রমের সুবিধাভোগী অধিকাংশই সমাজের অবহেলিত, দরিদ্র ও নিরক্ষর জনগোষ্ঠী ।   

এই কার্যক্রমের বিশালতা রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারকদের কাছে ইমামদের অপরিহার্যতা প্রমাণ করে। ১৯৯৩ সাল থেকে ২০১৯ শিক্ষাবর্ষ পর্যন্ত (৬ষ্ঠ পর্যায় পর্যন্ত), এই প্রকল্পের আওতায় প্রাক-প্রাথমিক, সহজ কুরআন শিক্ষা ও বয়স্ক শিক্ষাসহ ৩টি স্তরে সর্বমোট ২ কোটি ১৫ লক্ষ ৯ হাজার ৯৫০ জনকে সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি ধর্মীয় ও নৈতিকতা শিক্ষা প্রদান করা হয়েছে । এই পরিসংখ্যান দেখায় যে ইমামদের নেটওয়ার্ক বাংলাদেশের গ্রামীণ পর্যায়ে সরকারের শিক্ষা ও জনস্বাস্থ্য কার্যক্রমের সবচেয়ে শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম। তাদের আর্থ-সামাজিক কার্যক্রমের স্বীকৃতিই তাদের উচ্চতর বেতন স্কেলের যৌক্তিক ভিত্তি তৈরি করে।   

নিম্নলিখিত সারণীতে ইমামদের সম্প্রসারিত সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের ক্ষেত্রসমূহ দেখানো হলো:

ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক ইমামদের জন্য সম্প্রসারিত দায়িত্বের ক্ষেত্রসমূহ এবং তার গুরুত্ব

দায়িত্বের প্রকৃতি কার্যক্রমের ক্ষেত্র সামাজিক গুরুত্ব ও অবদান সূত্র
আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন কৃষি, বনায়ন, প্রাণীসম্পদ পালন, মৎস্য চাষ, প্রাথমিক চিকিৎসা। অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা অর্জন ও স্থানীয় খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ।
শিক্ষা ও নিরক্ষরতা দূরীকরণ প্রাক-প্রাথমিক, সহজ কুরআন ও বয়স্ক শিক্ষা কার্যক্রম। ২ কোটিরও অধিক শিক্ষার্থীকে শিক্ষাদান; প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির হার বৃদ্ধি।
জাতীয় নিরাপত্তা ও নৈতিকতা সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, মাদকাসক্তি, দুর্নীতি প্রতিরোধ ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। সামাজিক স্থিতিশীলতা ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তা রক্ষায় ফ্রন্টলাইন ভূমিকা।
সামাজিক সংস্কার যৌতুক, নারী ও শিশু নির্যাতন, সামাজিক কুসংস্কার নিরসন। সমাজের মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।

  

ঙ. কেমন হওয়া উচিৎ: আদর্শিক কাঠামো, মসজিদ ও সমাজের পুনর্গঠন

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ইমামদের বেতন, মর্যাদা ও দায়িত্বের আদর্শিক রূপটি কেবল অর্থনৈতিক সুরক্ষা প্রদানের মাধ্যমেই অর্জিত হতে পারে না, বরং প্রয়োজন একটি কাঠামোগত সংস্কার, যা তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সামাজিক নেতৃত্বকে একীভূত করবে।

৫.১. মসজিদে নববীর মডেলের অনুসরণ

মসজিদকে তার আদর্শিক ভূমিকায় ফিরিয়ে আনা প্রয়োজন। মাসুদ সাঈদী যেমনটি উল্লেখ করেছেন, মসজিদকে শুধু নামাজের জন্য সীমাবদ্ধ না রেখে, বরং সমাজ উন্নয়নের যাবতীয় কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা উচিত—ঠিক যেমনটি মসজিদে নববীতে করা হয়েছিল । যদি প্রতিটি মসজিদকে নবীজির দেখানো সেই মসজিদে নববীর রোল মডেল রূপে গড়ে তোলা যায়, তবে সমাজ শিক্ষার আলোয় আলোকিত হবে, নিরক্ষরতা দূর হবে, এবং সমাজে ব্যাপকভাবে জনকল্যাণমূলক কাজ পরিচালনা করা সম্ভব হবে ।   

ইমামগণকে অবশ্যই এই জনকল্যাণমূলক কাজের নেতৃত্ব দিতে হবে। এর জন্য তাদের নৈতিক যোগ্যতা (সৎ, নিষ্ঠাবান, তাকওয়াধারী) এবং প্রাতিষ্ঠানিক যোগ্যতা আবশ্যক । তাদের জিম্মাদারি শুধু ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং তা জনসাধারণের নৈতিক ও আদর্শিক নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার কর্মসূচি গ্রহণ পর্যন্ত প্রসারিত হবে।   

৫.২. আদর্শিক স্বাধীনতা এবং ভারসাম্যের প্রয়োজনীয়তা

রাষ্ট্রীয় বেতন স্কেল এবং সার্ভিস রুলস বাস্তবায়িত হলে, ইমামরা স্থানীয় মসজিদ কমিটির উপর অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা কমিয়ে স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালনের সুযোগ পাবেন। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা পেলে তারা নির্ভয়ে সামাজিক কুসংস্কার, দুর্নীতি এবং ভ্রান্ত মতবাদকে খণ্ডন করার আদর্শিক দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম হবেন ।   

তবে, এই আর্থিক স্বাধীনতা এবং রাষ্ট্রীয় সম্পৃক্ততার মধ্যে একটি ভারসাম্য বজায় রাখা অত্যাবশ্যক। ইমামদের ধর্মীয় দায়িত্ব পালনে স্বাধীনতা নিশ্চিত করা জরুরি, যাতে তারা রাষ্ট্রের নীতিগত লক্ষ্যের (যেমন জঙ্গিবাদ দমন, দুর্নীতি প্রতিরোধ) সাথে যুক্ত থাকলেও, সমাজের স্বাধীন পথপ্রদর্শক হিসেবে নিজেদের ভূমিকা বজায় রাখতে পারেন। একটি শক্তিশালী আইনি নীতিমালা (সার্ভিস রুল) প্রণয়ন করা হলে তা ইমামের মর্যাদা ও স্বাধীনতার মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে পারবে।

চ. নীতিগত সুপারিশ ও কর্মপরিকল্পনা: একটি সমন্বিত রোডম্যাপ

ইমামদের মর্যাদা ও কার্যকারিতা বৃদ্ধির জন্য নিম্নলিখিত নীতিগত পদক্ষেপগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করা অপরিহার্য:

৬.১. বেতন স্কেল এবং টেকসই অর্থায়ন

প্রথমত, ধর্ম মন্ত্রণালয়ের খসড়া প্রস্তাবিত বেতন স্কেলটি (সর্বোচ্চ দেড় লাখ, সর্বনিম্ন ২৫ হাজার) দ্রুততার সাথে চূড়ান্ত করে গেজেট আকারে প্রকাশ করা । দ্বিতীয়ত, ইমাম-মুয়াজ্জিন কল্যাণ ট্রাস্টের জন্য পরিকল্পিত বাণিজ্যিক উদ্যোগগুলি, যেমন মিনারেল ওয়াটার ‘ইমাম’ বোতলজাতকরণ প্রকল্প , দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে এবং এই রাজস্ব প্রবাহের মাধ্যমে ট্রাস্টের তহবিলকে স্বাবলম্বী করে তোলার প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ তদারকির আওতায় আনতে হবে।   

৬.২. সার্ভিস রুলস ও আইনি কাঠামো প্রতিষ্ঠা

ইমামদের পেশাগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে একটি জাতীয় কমিটি গঠন করে তাদের জন্য চাকরির নীতিমালা, সার্ভিস রুলস ও নিয়োগবিধি প্রণয়ন করা আবশ্যক । এই নীতিমালা মসজিদ কমিটিগুলোর স্থানীয় ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ করবে এবং ইমামদের চাকরির নিশ্চয়তা দেবে।   

৬.৩. রাষ্ট্রীয় জনকল্যাণমূলক কাজে যোগ্য ইমামদের সম্পৃক্তকরণ

দাওরায়ে হাদিস সনদপ্রাপ্ত যোগ্য আলেমদেরকে সরকারি স্কুল-কলেজে ধর্মীয় শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের জন্য বিশেষ প্রক্রিয়া শুরু করা উচিত, যা তাদের শিক্ষার মূল্যায়নে সহায়ক হবে । এছাড়াও, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ইমামদের স্থানীয় কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও উন্নয়ন কমিটির সদস্য হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দিতে হবে। এটি তাদের সামাজিক পুঁজি (Social Capital) ব্যবহার করে জনকল্যাণমূলক প্রকল্পের সফলতা বহুলাংশে বৃদ্ধি করবে ।   

৬.৪. প্রশিক্ষণের আধুনিকীকরণ ও তদারকি

ইসলামিক ফাউন্ডেশন ইমাম প্রশিক্ষণ একাডেমিগুলোর মাধ্যমে প্রদত্ত প্রশিক্ষণে আইসিটি-বিষয়ক দক্ষতা  এবং আধুনিক নেতৃত্বের গুণাবলী বিকাশে আরও জোর দেওয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি, দুর্নীতি প্রতিরোধে , সামাজিক সম্প্রীতি রক্ষায় এবং সামাজিক কুসংস্কার নিরসনে ইমামদের ভূমিকা আরও জোরদার করার জন্য প্রশিক্ষণ মডিউলগুলোকে সময়োপযোগী করা প্রয়োজন।   

ছ. উপসংহার: সামাজিক স্থিতিশীলতায় ইমামদের অপরিহার্যতা

বাংলাদেশের মসজিদের ইমামগণ দেশের সামাজিক, নৈতিক এবং শিক্ষাগত কাঠামোতে এক অপরিহার্য শক্তি হিসেবে কাজ করেন। তারা ২ কোটিরও অধিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে শিক্ষা বিস্তার করে নিরক্ষরতা দূরীকরণে সরকারকে সহযোগিতা করেছেন  এবং সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে ফ্রন্টলাইন কর্মী হিসেবে ভূমিকা রাখছেন । তাদের এই বহুমুখী ও গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক দায়িত্বের বিপরীতে অর্থনৈতিক অবহেলা কেবল তাদের ব্যক্তিগত জীবনকেই দুর্বিষহ করে না, বরং দেশের সামাজিক উন্নয়ন প্রচেষ্টার কার্যকারিতাকেও হ্রাস করে।   

অতএব, ইমামদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করা কেবল ধর্মীয় দায়িত্ব পালন নয়, বরং জাতীয় উন্নয়ন ও সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য অপরিহার্য বিনিয়োগ। নতুন বেতন স্কেলের প্রস্তাব এবং নীতিগত উদ্যোগগুলো যদি দ্রুত ও স্বচ্ছভাবে বাস্তবায়িত হয়, তবে ইমামরা বেতন বৈষম্যের অন্ধকার যুগ থেকে বেরিয়ে এসে আধুনিক বাংলাদেশের একজন সম্মানিত ও সুরক্ষিত জাতীয় পেশাজীবী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারবেন। মসজিদকে আধুনিক ‘মসজিদে নববী’র মডেলে রূপান্তর করে সমাজকল্যাণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করার মাধ্যমেই দেশের বৃহত্তর জনকল্যাণ নিশ্চিত করা সম্ভব। এই কাঠামোগত পরিবর্তনই ইমাম সমাজকে তাদের ঐতিহাসিক জিম্মাদারি পূর্ণাঙ্গভাবে পালনের সুযোগ দেবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *