জনবান্ধব পুলিশ: বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট ও নাগরিক নিরাপত্তার নতুন দিগন্ত

বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে জনবান্ধব পুলিশ গড়ে তোলার পদ্ধতি: আইনি সংস্কার, জবাবদিহিতা ও স্মার্ট নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের টেকসই কৌশল

১. সূচনা: জনবান্ধব পুলিশিং কেন অপরিহার্য?

১.১. প্রেক্ষিত: সনাতনী আইন প্রয়োগকারী সংস্থা থেকে গণমুখী সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর

আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে কেবল দমনমূলক বা প্রতিক্রিয়াশীল (Reactive) ভূমিকা থেকে সরিয়ে এনে সমস্যা সমাধানকারী (Problem-Solving) এবং প্রতিরোধমূলক (Proactive) সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করার দর্শনই হলো জনবান্ধব পুলিশিং (People-Friendly Policing) । বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জনবান্ধব পুলিশি ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে ইতোমধ্যে দেশব্যাপী কমিউনিটি পুলিশিং কার্যক্রমকে বেগবান করা হয়েছে, যার ফলে পুলিশের কার্যক্রমে জনগণের আস্থা, সহযোগিতা ও অংশীদারিত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে । বিশেষত বিশ্ব শান্তি রক্ষায় জাতিসংঘের মিশনসমূহে নারী পুলিশ সদস্যগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করেছে ।   

তবে কাঙ্ক্ষিত সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে কিছু বড় সমস্যা বিদ্যমান, যার মধ্যে অন্যতম হলো অপর্যাপ্ত জনবল ও লজিস্টিকস সাপোর্ট । এই সমস্যাগুলো নিরসনের লক্ষ্যে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় দেশের জনসংখ্যা ও পুলিশের অনুপাত অন্যূন ৫০০:১-এ নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, যাতে পুলিশের সেবা জনগণের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছানো সম্ভব হয় । জনগণের সাথে মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে পুলিশের কাজে জনগণের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাওয়ায়, এটি প্রমাণিত যে পুলিশের সাংগঠনিক সংস্কারে জনসম্পৃক্ততা একটি অনিবার্য উপাদান।   

১.২. জনবান্ধব পুলিশিংয়ের সংজ্ঞা ও বৈশ্বিক মডেল

জনবান্ধব পুলিশিংয়ের দার্শনিক ভিত্তি হলো ‘কমিউনিটি পুলিশিং’ (CP), যা প্রথাগতভাবে দমনমূলক পুলিশিং থেকে আলাদা । এই ধারণার মূল উৎস আধুনিক পুলিশিংয়ের জনক স্যার রবার্ট পিলের প্রবর্তিত দর্শন: “পুলিশই জনতা এবং জনতাই পুলিশ” (The police are public and the public are police) । এই দর্শন অনুযায়ী, কমিউনিটি পুলিশিং একটি সংগঠনভিত্তিক ব্যবস্থাপনা দর্শন, যা জনগণ, সরকার ও পুলিশের অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে পরিচালিত হয় ।   

কমিউনিটি পুলিশিংয়ের অন্যতম মূল উপাদান হলো জনগণের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ, সরাসরি, ও দৈনন্দিন মুখোমুখি যোগাযোগ স্থাপন করা। এর মাধ্যমে পুলিশকে শুধু আইন প্রয়োগ ও গ্রেপ্তারের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে, স্থানীয় জনগণের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে স্থানীয় সমস্যা ও সমস্যার কারণ চিহ্নিত করে প্রতিরোধমূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে তার সমাধান করতে হয় । এই মডেল পুলিশ ও নাগরিকদের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা ও শ্রদ্ধার ভিত্তিতে একটি নতুন সম্পর্ক তৈরি করে । এটি কেবল অপরাধ দমনের কৌশল নয়, বরং সমাজের সামগ্রিক জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের একটি দীর্ঘমেয়াদী উদ্যোগ, যেখানে নাগরিকদেরও তাদের নিরাপত্তা ও কল্যাণের জন্য দায়িত্ব গ্রহণ করতে উৎসাহিত করা হয় ।   

১.৩. বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে জনবান্ধব পুলিশিংয়ের প্রয়োজনীয়তা ও চ্যালেঞ্জসমূহ

নাগরিক জীবনে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা, অপরাধ দমন ও সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে জনগণের সাথে পুলিশি সম্পর্কের উন্নয়ন অপরিহার্য; আর এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য কমিউনিটি পুলিশিংয়ের কোনো বিকল্প নেই । সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ পুলিশ জঙ্গিবাদ দমন, গণতন্ত্র রক্ষা ও জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দেশপ্রেম ও পেশাদারিত্বের পরিচয় দিয়েছে ।   

তবে জনবান্ধব পুলিশিং বাস্তবায়নে কাঠামোগত ও সাংস্কৃতিক উভয় ধরনের চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান। আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক দিক থেকে সবচেয়ে বড় বাধা হলো ১৮৬১ সালের ঔপনিবেশিক পুলিশ আইনের মাধ্যমে পুলিশ বাহিনী পরিচালিত হওয়া । এই ঔপনিবেশিক আইনি কাঠামোর কারণে পুলিশের সাংগঠনিক কাঠামো, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধে গণমুখী পরিবর্তন আনা কঠিন হয়ে পড়েছে । এর পাশাপাশি, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, ব্যাপক দলীয়করণ এবং জবাবদিহিতার ঘাটতির ফলে পুলিশ বাহিনী প্রায়শই ক্ষমতার অপব্যবহার, ঘুষ, নির্যাতন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে । এই রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতাগুলি জনবান্ধব পুলিশিংয়ের মূল দর্শনকে মাঠ পর্যায়ে কার্যকরভাবে প্রতিষ্ঠা করার পথে অন্যতম প্রধান প্রতিবন্ধকতা।   

২. মূল কৌশলগত ভিত্তি: কমিউনিটি পুলিশিং ও জনগণের অংশীদারিত্ব

২.১. কমিউনিটি পুলিশিং (CP) এবং বিট পুলিশিং (BP): কার্যকারিতা ও সীমাবদ্ধতা

বাংলাদেশে জনবান্ধব পুলিশিংয়ের কৌশলগত ভিত্তি হিসেবে কমিউনিটি পুলিশিং কার্যক্রম সারা দেশে বেগবান করা হয়েছে। এটি একটি গণমুখী, প্রতিরোধমূলক এবং সমস্যা সমাধানমূলক পুলিশি ব্যবস্থা । এর কার্যকারিতা বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয় স্থানীয় পর্যায়ে বিরোধ নিষ্পত্তির মাধ্যমে। ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এক বছরে কমিউনিটি পুলিশিং ও বিট পুলিশিংয়ের মাধ্যমে সারা দেশে প্রায় ১ লাখ ৯৩ হাজার ৯৪৪টি বিরোধ নিষ্পত্তি করা সম্ভব হয়েছে । এই পরিসংখ্যান প্রমাণ করে যে স্থানীয় কমিউনিটি পুলিশিং কমিটিগুলি সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।   

জনগণের কাছে পুলিশের সেবাকে দ্রুত ও কার্যকরভাবে পৌঁছে দিতে প্রতিটি থানাকে ইউনিয়নভিত্তিক (বা মেট্রোপলিটন এলাকায় ওয়ার্ডভিত্তিক) এক বা একাধিক ইউনিটে ভাগ করে বিট পুলিশিং চালু করা হয়েছে । বিট পুলিশিং ব্যবস্থায় প্রতিটি বিটে একজন বা একাধিক কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করেন এবং তারাই মূলত স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করে কমিউনিটি পুলিশিং কার্যক্রম পরিচালনা করেন ।   

তবে উচ্চমাত্রার বিরোধ নিষ্পত্তি সত্ত্বেও, এই কার্যক্রমের কার্যকারিতার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈপরীত্য লক্ষ্য করা যায়। কমিউনিটি পুলিশিং কমিটির সদস্যদের অভিযোগ হলো, তারা অনেক ক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্ট বিট পুলিশের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে কার্যকর সহায়তা পান না । উদাহরণস্বরূপ, মাদক, চুরি বা ছিনতাইয়ের মতো গুরুতর অপরাধের তথ্য দেওয়ার পরও অনেক সময় বিট পুলিশ কর্মকর্তারা কার্যকর ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হন, যার ফলে কমিউনিটি সদস্যদের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি হয় এবং পুলিশ-জনতার দূরত্ব বেড়ে যায় । এই পরিস্থিতি থেকে বোঝা যায় যে, কমিউনিটি পুলিশিংয়ের দর্শনটি গৃহীত হলেও, পুলিশের অভ্যন্তরে সনাতনী ও প্রতিক্রিয়াশীল মানসিকতা এখনও প্রবলভাবে বিরাজমান, যা গণমুখী কার্যক্রমকে পুরোপুরি সমর্থন করছে না। এই অভ্যন্তরীণ বাধা নিরসনের জন্য বিট পুলিশিং কর্মকর্তাদের কর্মদক্ষতা মূল্যায়নে শুধু আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা নয়, বরং জনসম্পৃক্ততা ও বিরোধ নিষ্পত্তির হারকেও প্রধান মাপকাঠি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি।   

২.২. পুলিশ ও জনগণের আস্থা ও সহযোগিতার মডেল তৈরি

পুলিশ ও জনগণের মধ্যে কার্যকর অংশীদারিত্বের জন্য পুলিশ সদস্যদের আচরণে মৌলিক পরিবর্তন আনা আবশ্যক। আস্থা তৈরির পূর্বশর্ত হলো পুলিশকে অবশ্যই জনগণের সঙ্গে শ্রদ্ধা ও সংবেদনশীলতার সঙ্গে আচরণ করতে হবে । রূঢ়তা, ঔদ্ধত্য, বা কোনো ধরনের অপ্রয়োজনীয় বলপ্রয়োগ জনগণের পক্ষ থেকে জনসমর্থন ও সহযোগিতা অর্জনের আগ্রহকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে ।   

কমিউনিটি পুলিশিংয়ের মাধ্যমে এলাকার অপরাধ দমন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশের সহায়ক শক্তি হিসেবে একটি শক্তিশালী গণফোরাম তৈরি করা যায় । এই গণফোরাম অপরাধীদের নির্বিঘ্নে অপরাধ সংগঠনের সাহসকে হ্রাস করে এবং জনগণের মধ্যে পুলিশী ভীতি কমিয়ে নিরাপত্তাবোধ সৃষ্টি করে । কমিউনিটি পুলিশিং কর্মকর্তার ভূমিকা কেবল তাৎক্ষণিক সেবার আহ্বানে সাড়া দেওয়া বা গ্রেপ্তারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। তাদের দায়িত্ব হলো সমাজের সকল উপাদান (যেমন—স্থানীয় সরকার, স্কুল, সামাজিক সংস্থা) কে যুক্ত করে স্থানীয় উদ্বেগের দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের জন্য সৃজনশীল উদ্যোগ গ্রহণ করা । একজন কমিউনিটি পুলিশিং কর্মকর্তা এই প্রক্রিয়ায় জনগণের সমস্যা সমাধানের অনুঘটক (catalyst) হিসেবে কাজ করেন, যার মাধ্যমে জনগণ পুলিশের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে অবহিত হয় এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে সহযোগিতা করতে উদ্বুদ্ধ হয় ।   

২.৩. নারী ও শিশু বান্ধব পুলিশিং: জেন্ডার সংবেদনশীলতা বৃদ্ধি

একটি জনবান্ধব পুলিশি ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য নারী ও শিশু বান্ধব এবং জেন্ডার সংবেদনশীল পুলিশিং কার্যক্রম সমুন্নত রাখা অপরিহার্য । এই লক্ষ্যে পুলিশের সাংগঠনিক কাঠামোতে অধিক সংখ্যক নারী পুলিশ নিয়োগ করা প্রয়োজন ।   

কমিউনিটি পুলিশিংয়ের কার্যক্রমের মধ্যে নারী ও শিশুদের সুরক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে নারী নির্যাতন, শিশু শ্রম, বাল্য বিবাহ, যৌতুক এবং নারীর প্রতি বৈষম্যের বিরুদ্ধে গণসচেতনতা সৃষ্টি ও সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার কর্মসূচী গ্রহণ করা । একইসাথে, বখাটেদের উৎপাত বন্ধ করার জন্য তাদের চিহ্নিত করে অভিভাবক ও সমাজের মুরব্বীদের মাধ্যমে চাপ প্রয়োগ করে বাস্তবসম্মত সমাধানের কর্মসূচী নিতে হবে । জেন্ডার সংবেদনশীল পুলিশিং নিশ্চিত হলে সমাজের দুর্বলতম অংশটি পুলিশের উপর আস্থা রাখতে পারবে।   

৩. প্রাতিষ্ঠানিক ও আইনি সংস্কার: জনবান্ধব পুলিশিংয়ের ভিত্তি স্থাপন

৩.১. ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: ১৮৬১ সালের পুলিশ আইন থেকে আধুনিকীকরণ

বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনী এখনও ১৮৬১ সালের সেই ঔপনিবেশিক পুলিশ আইন দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে, যা ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের ভয়াবহতার প্রেক্ষাপটে প্রণীত হয়েছিল । এই আইনের মূল স্পিরিট এখনও বহাল আছে এবং এটি মূলত ঔপনিবেশিক শক্তির শাসন ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে তৈরি হয়েছিল, জনসেবার জন্য নয় । ফলে, পুলিশ রিফর্ম প্রজেক্টের (পিআরপি) অধীনে পুলিশ সংস্কারের জন্য অধ্যাদেশ প্রস্তাব করা হলেও, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে তা আলোর মুখ দেখেনি ।   

বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১৮৬১ সালের আইনের মূল লক্ষ্য দমনমূলক মানসিকতার জন্ম দিয়েছে। এই আইনি অচলাবস্থা আধুনিক গণমুখী (Community Oriented) পুলিশিংয়ের দর্শনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। যতক্ষণ পর্যন্ত এই পুরনো ঔপনিবেশিক কাঠামো বহাল থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত পুলিশের সাংগঠনিক কাঠামো, চর্চিত সংস্কৃতি এবং লালিত আদর্শে কাঠামোগত পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে না । তাই, পুলিশ কমিশনকে অবশ্যই খসড়া পুলিশ অধ্যাদেশের জনস্বার্থের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ধারাগুলো বাদ দিয়ে জনমুখী ও জবাবদিহির ধারাগুলো বিবেচনায় নিয়ে একটি সম্পূর্ণ নতুন পুলিশ আইন প্রণয়নের মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের ভিত্তি স্থাপন করতে হবে ।   

৩.২. পুলিশ সংস্কার কমিশনের সুপারিশমালা (২০২৪-২০২৫): স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি কৌশল

বর্তমান পুলিশ সংস্কার কমিশন (২০২৪-২০২৫) জনবান্ধব পুলিশিংয়ের ভিত্তি স্থাপনের লক্ষ্যে স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি সুপারিশমালা প্রণয়ন করেছে। কমিশন ১৫টি থিমেটিক বিষয়ের ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—মানবাধিকার সুরক্ষা, বলপ্রয়োগ নীতি, নিরপেক্ষতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ, বিদ্যমান আইনি কাঠামোর সংস্কার এবং জনসম্পৃক্ত পুলিশিংয়ের প্রসার ।   

মানবাধিকার সুরক্ষার ক্ষেত্রে, কমিশন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তদন্তের পূর্ণ ক্ষমতা দেওয়ার সুপারিশ করেছে । এছাড়া, ভুক্তভোগী ও সাক্ষী সুরক্ষায় একটি স্বতন্ত্র সুরক্ষা আইন প্রণয়ন এবং র‍্যাবের অতীত কার্যক্রম পর্যালোচনা করে এর প্রয়োজনীয়তা পুনর্মূল্যায়নের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে ।   

মব নিয়ন্ত্রণে পুলিশের বলপ্রয়োগ নীতির ক্ষেত্রেও আধুনিকায়ন প্রয়োজন। কমিশন জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনীর বলপ্রয়োগ নীতিমালার অনুসরণে পাঁচ ধাপের একটি বলপ্রয়োগ পরিকল্পনাকে আইনগত বৈধতা দেওয়ার সুপারিশ করেছে। এই পরিকল্পনাটি ন্যূনতম ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানির ঝুঁকি এড়িয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে সহায়ক হবে । একইসঙ্গে, অযাচিত হয়রানির (আটক/গ্রেপ্তার, তল্লাশি ও জিজ্ঞাসাবাদকেন্দ্রিক) অবসান ঘটানো এবং ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮ এর ৫৪ ও ১৬৭ ধারার অপব্যবহার রোধে হাইকোর্টের নির্দেশাবলীর যথাযথ প্রতিপালন নিশ্চিত করা অপরিহার্য ।   

৩.৩. রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ নিরসন এবং পুলিশ সার্ভিসের বিরাজনীতিকরণ

পুলিশ বাহিনীর পেশাদারিত্ব ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে হলে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জটি হলো এর বিরাজনীতিকরণ। পুলিশের নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি ও চাকরিচ্যুতির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করতে হবে । ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর বিশ্লেষণেও দেখা যায়, অবাধ রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং ব্যাপক দলীয়করণের ফলেই বাংলাদেশ পুলিশ একটি অপেশাদার, জনবিচ্ছিন্ন এবং দুর্নীতিতে নিমজ্জিত সংস্থায় পরিণত হয়েছে ।   

রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে পুলিশ বাহিনীকে প্রায়শই সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে নয়, বরং রাজনৈতিক নিপীড়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয় । এই পরিস্থিতি পুলিশের প্রতি জনগণের অবিশ্বাসকে আরও গভীর করে। সুতরাং, প্রস্তাবিত পুলিশ কমিশনের জন্য রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে কাজ করা এবং নিরপেক্ষতা বজায় রাখাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ । পুলিশ বাহিনীর নিরপেক্ষতা ও পেশাদারিত্ব নিশ্চিত করার মাধ্যমেই জনবান্ধব পুলিশিংয়ের দর্শন বাস্তবে কার্যকর করা সম্ভব।   

৪. জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণ: আস্থা পুনরুদ্ধারের অপরিহার্য পদক্ষেপ

৪.১. পুলিশি অপরাধ ও ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণ বিশ্লেষণ

জনবান্ধব পুলিশিংয়ের প্রধান বাধা হলো দায়মুক্তির সংস্কৃতি। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, ব্যাপক দলীয়করণ, সংগঠিত অপরাধের দায়মুক্তি (Impunity) এবং জবাবদিহির ঘাটতির ফলে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী ক্ষমতার অপব্যবহারের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছে । এই ক্ষমতার অপব্যবহারের মধ্যে রয়েছে ঘুষ, চাঁদাবাজি, নির্যাতন, গুম, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন ।   

যখন পুলিশকে কেবল রাজনৈতিক নিপীড়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয় , তখন এটি তার সেবাদানকারী ভূমিকা থেকে সরে আসে। এটি একটি সুস্পষ্ট কার্যকারণ সম্পর্ক নির্দেশ করে: জবাবদিহিতার অভাব এবং দায়মুক্তির সংস্কৃতি অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডকে উৎসাহিত করে, যার ফলস্বরূপ জনগণের আস্থা হ্রাস পায় এবং কমিউনিটি পুলিশিংয়ের সফলতা সীমিত হয়ে আসে। এই চক্র ভাঙতে হলে স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী জবাবদিহিতা কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করা অপরিহার্য।   

৪.২. স্বাধীন জবাবদিহিতা কাঠামো প্রতিষ্ঠা

পুলিশের নিরপেক্ষতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধিকরণের জন্য একটি স্বতন্ত্র এবং স্বাধীন কাঠামো তৈরি করা প্রয়োজন। প্রথমত, পুলিশের নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি এবং অভ্যন্তরীণ তদারকিকে নির্বাহী বিভাগ/সরকারের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করতে আন্তর্জাতিক উত্তম চর্চার আলোকে স্বাধীন ‘পুলিশ সার্ভিস কমিশন’ গঠন করা উচিত ।   

দ্বিতীয়ত, পুলিশ সদস্য কর্তৃক উত্থাপিত অনিয়ম-দুর্নীতি, অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন সম্পর্কিত অভিযোগ গ্রহণ, তদন্ত এবং সুপারিশ করার জন্য একটি স্বতন্ত্র ‘অভিযোগ নিষ্পত্তি দপ্তর/কর্তৃপক্ষ (Independent Office/Authority for Police Conduct)’ প্রতিষ্ঠা করা অপরিহার্য । বর্তমান কাঠামোতে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত পুলিশ নিজেই করে, যা নিরপেক্ষতার অভাব তৈরি করে। স্বাধীন অভিযোগ নিষ্পত্তি কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করে ক্ষমতার ভারসাম্যতা নিশ্চিত করা গেলে জনগণের আস্থার মূলধন পুনরুদ্ধার সম্ভব হবে। এছাড়া, অভিযোগ দাখিল প্রক্রিয়া সহজীকরণে জনসাধারণের জন্য টোল-ফ্রি হটলাইন ও ওয়েবসাইট চালু করা এবং বাংলাদেশ পুলিশ সদস্য কর্তৃক সংগঠিত অপরাধের ধরন, শাস্তির ধরন এবং শাস্তিপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্যদের তথ্য নিয়মিত ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা উচিত ।   

সারণী ৪.এ: পুলিশ সংস্কারে টিআইবি’র সুপারিশ ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্র

সংস্কারের ক্ষেত্র টিআইবি’র প্রধান সুপারিশ জনবান্ধব পুলিশিংয়ে প্রভাব
আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা স্বাধীন ‘পুলিশ সার্ভিস কমিশন’ গঠন রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ হ্রাস ও পেশাদারিত্ব বৃদ্ধি
অভিযোগ নিষ্পত্তি স্বতন্ত্র ‘অভিযোগ নিষ্পত্তি কর্তৃপক্ষ’ প্রতিষ্ঠা পুলিশি অনিয়মের দ্রুত ও নিরপেক্ষ তদন্ত নিশ্চিতকরণ
বিচার প্রক্রিয়া পুলিশ সদস্য কর্তৃক সংগঠিত অপরাধের জন্য বিশেষ বিচার বিভাগীয় ট্রাইব্যুনাল গঠন দায়মুক্তি (Impunity) সংস্কৃতি বিলোপ ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা
স্বচ্ছতা টোল-ফ্রি হটলাইন ও ওয়েবসাইটে শাস্তির তথ্য প্রকাশ জনগণের কাছে অভিযোগ প্রক্রিয়া সহজীকরণ

  

৪.৩. ভুক্তভোগী ও সাক্ষী সুরক্ষা আইন প্রণয়ন ও বিচারিক প্রক্রিয়া

মানবাধিকার সুরক্ষার জন্য ভুক্তভোগী ও সাক্ষী সুরক্ষায় একটি সুরক্ষা আইন প্রণয়ন এবং এর দ্রুত বাস্তবায়ন জরুরি । পুলিশ সদস্য কর্তৃক সংগঠিত অপরাধের বিচার দ্রুত সম্পন্ন করার জন্য বিশেষ বিচার বিভাগীয় ট্রাইব্যুনাল গঠন করা প্রয়োজন । একইসঙ্গে, ‘নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩’-এর যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা আবশ্যক। এই আইনে ‘মানসিক নির্যাতন’-এর বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে আইনের ব্যাপ্তি বাড়ানো উচিত । এছাড়া, সন্দেহজনক নাগরিকদের নির্বিচারে পরোয়ানা ছাড়া গ্রেপ্তার সংক্রান্ত ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮ এর ৫৪ ও ১৬৭ ধারার অপব্যবহার রোধে হাইকোর্টের নির্দেশাবলীর যথাযথ প্রতিপালন নিশ্চিত করা প্রয়োজন ।   

৪.৪. দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি বাস্তবায়ন

জনবান্ধব পুলিশিং নিশ্চিত করতে হলে পুলিশকে শতভাগ দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে। এ প্রসঙ্গে পুলিশ সংস্কার সম্পর্কিত সংলাপে এবং প্রতিবেদক জে এইচ সুমন কর্তৃক জনতা নিউজ-এ উত্থাপিত দাবি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জে এইচ সুমন এবং অন্যান্য প্রতিনিধিরা পুলিশে নিয়োগ বাণিজ্য, বদলি বাণিজ্য এবং মামলা বাণিজ্য বন্ধ করে থানাগুলোকে জনবান্ধব হিসেবে গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন । পুলিশি অনিয়ম ও হয়রানির অভিযোগ যাচাইয়ে একটি স্বাধীন তদন্ত ইউনিট গঠনের প্রস্তাবও উত্থাপিত হতে পারে । জনবান্ধব আচরণের ভিত্তি হলো পেশাদারিত্ব, যা দুর্নীতির মূল শিকড় উপড়ে ফেলার মাধ্যমে নিশ্চিত হয়। পুলিশের কর্মপরিবেশের উন্নয়ন এবং দুর্নীতি প্রতিরোধকে ১৫টি থিমেটিক বিষয়ের একটি হিসেবে পুলিশ সংস্কার কমিশনও গুরুত্ব দিয়েছে ।   

৫. সক্ষমতা বৃদ্ধি ও পেশাদারিত্ব উন্নয়ন: প্রশিক্ষণে আধুনিকায়ন

৫.১. পুলিশ প্রশিক্ষণের পাঠ্যসূচিতে পরিবর্তন

পুলিশের দক্ষতা ও পেশাদারিত্ব বৃদ্ধির জন্য যুগোপযোগী প্রশিক্ষণের কোনো বিকল্প নেই। সনাতনী জবানবন্দিভিত্তিক তদন্তের উপর নির্ভরতা কমিয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক তদন্তের মাধ্যমে অপরাধ উদ্ঘাটনের দিকে জোর দিতে হবে । প্রশিক্ষণে আধুনিক প্রযুক্তিগত কৌশল যেমন ফরেনসিক, আর্থিক অপরাধ বিভাগের তদন্ত, মানবাধিকার এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহারকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে ।   

প্রশিক্ষণের মূল লক্ষ্য হলো—জনবান্ধব, বাস্তবসম্মত এবং প্রায়োগিক প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে প্রশিক্ষিত পুলিশ সদস্যগণ কর্তৃক মাঠ পর্যায়ে হয়রানীমুক্ত মানসম্মত সেবা প্রদান নিশ্চিত করা, যা শেষ পর্যন্ত পুলিশের ভাবমূর্তি বৃদ্ধি ও জনগণের আস্থা অর্জনে সহায়ক হবে । এছাড়া, প্রশিক্ষকদের সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং নিয়মিতভাবে সময়োপযোগী মানসম্মত আইটি ভিত্তিক প্রশিক্ষণ প্রদান করাও এই প্রক্রিয়ার গুরুত্বপূর্ণ অংশ ।   

৫.২. মেন্টাল হেলথ সাপোর্ট: পুলিশের পেশাগত মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন

জনবান্ধব পুলিশ বাহিনী নির্মাণে কেবল কাঠামোগত সংস্কার যথেষ্ট নয়; পুলিশ সদস্যদের পেশাগত মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়াও জরুরি। একজন পুলিশ কর্মকর্তার উপর উচ্চ পেশাগত চাপ, অপর্যাপ্ত লজিস্টিকস  এবং অভ্যন্তরীণ অসহযোগিতা  বিদ্যমান থাকে। এই পরিবেশে যদি মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন না নেওয়া হয়, তবে তার আচরণে রূঢ়তা এবং সংবেদনশীলতার অভাব দেখা দিতে পারে, যা জনবান্ধব পুলিশিংয়ের নীতির ব্যর্থতা ডেকে আনে ।   

এই কারণে, সাংগঠনিকভাবেই পুলিশ বাহিনীতে প্রফেশনাল মেন্টাল হেলথ সাপোর্ট সেন্টার সহজলভ্য করা আবশ্যক । মানসিক সাহায্য নেওয়ার বিষয়টাকে উৎসাহিত করার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নিলে পুলিশ বাহিনীর আচরণে মানবিকতা এবং সংবেদনশীলতা নিশ্চিত হবে, যা জনবান্ধব ভাবমূর্তি নির্মাণে সহায়ক ।   

৫.৩. লজিস্টিকস ও জনবলের ঘাটতি নিরসন

জনবান্ধব পুলিশিংয়ের পথে অন্যতম বাস্তব সমস্যা হলো অপর্যাপ্ত জনবল ও লজিস্টিকস সাপোর্ট । জনবল বৃদ্ধি এবং যুগোপযোগী ও প্রয়োজনভিত্তিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পুলিশের দক্ষতা বৃদ্ধি করা সম্ভব। পুলিশের সাংগঠনিক কাঠামোতে নৌ পুলিশ, ট্যুরিস্ট পুলিশ, এবং নতুন মেট্রোপলিটন পুলিশ ইউনিট (যেমন রংপুর, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও কুমিল্লা) গঠন করে জনবলের ঘাটতি পূরণের এবং সেবার পরিধি বাড়ানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে ।   

৬. প্রযুক্তির ব্যবহার: স্মার্ট পুলিশিং ও সেবার সহজীকরণ

৬.১. ডিজিটাল সেবা প্ল্যাটফর্মের সর্বোচ্চ ব্যবহার

প্রযুক্তির ব্যবহার পুলিশি সেবাকে জনগণের কাছে দ্রুত ও স্বচ্ছভাবে পৌঁছে দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে ল্যান্ড ও মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ৯৯৯ জরুরি সেবা পাওয়া যায়, যা পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস, অ্যাম্বুলেন্স ও জরুরি মেডিক্যাল সেবা নিশ্চিত করে। শুরু থেকে অদ্যাবধি মোট ২ কোটিরও বেশি কল করা হয়েছে এবং ৪৬ লক্ষের বেশি সেবা প্রদান করা হয়েছে । এই তাৎক্ষণিক সাড়া প্রদান জনগণের মধ্যে আস্থা তৈরি করেছে।   

এছাড়াও, বাংলাদেশ পুলিশ কর্তৃক অনলাইন পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট (PCC) সেবা চালু করা হয়েছে, যার মাধ্যমে নাগরিকেরা অনলাইনে দ্রুততম সময়ে আবেদন করতে পারেন এবং হয়রানি মুক্ত সেবা পান । এই ব্যবস্থাটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এবং জাতিসংঘের অধীনে অনুষ্ঠিত World Summit on the Information Society (WSIS) Prize-2018 অর্জন করেছে । জনগনকে পুলিশি সেবা প্রদানের লক্ষ্যে ‘বিডি পুলিশ হেল্প লাইন’ নামক একটি মোবাইল অ্যাপসও চালু করা হয়েছে। এর মাধ্যমে জনসাধারণ উর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদেরকে অপরাধ সংক্রান্ত তথ্য, কথোপকথন, ছবি ও ভিডিও প্রেরণ করতে পারে, যা জনগণের সরাসরি সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি করেছে ।   

৬.২. ডাটা-ভিত্তিক পুলিশিং (Data-Driven Policing)

আধুনিক পুলিশিংয়ে তথ্যের ব্যবহার অপরিহার্য। পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে Centralized Digital Management System (CDMS) নামে একটি ডিজিটাল ও ওয়েব বেইজড তথ্য ভান্ডার গড়ে তোলা হয়েছে, যেখানে ১৪ লক্ষাধিক মামলা এবং ৫০ লক্ষাধিক ব্যক্তি সম্পর্কিত তথ্য এন্ট্রি করা হয়েছে । এর ফলে অপরাধীদের আইনের আওতায় আনার ক্ষেত্রে একটি সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে এবং অপরাধী সম্পর্কে যেকোনো তথ্য সহজে পাওয়া যায় ।   

এছাড়াও, বাড়ির মালিক ও ভাড়াটিয়াদের তথ্যাদি যথাযথভাবে সংরক্ষণের জন্য ‘সিটিজেন ইনফরমেশন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম’ (CIMS) চালু করা হয়েছে, যার মাধ্যমে অতি সহজেই অপরাধীকে শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে । অপরাধী শনাক্তকরণ ও অপরাধ ভীতি হ্রাসের লক্ষ্যে NID এর তথ্য ভান্ডার ব্যবহার করে অপরাধী সনাক্ত করা এবং পুলিশের অপারেশনাল ইউনিটসমূহে AFIS (Automated Fingerprint Identification System) এর কার্যক্রম সম্প্রসারিত করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে ।   

৬.৩. সাইবার নিরাপত্তা ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বৃদ্ধি

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহার করে সংঘটিত সাইবার ক্রাইম দমন বর্তমানে একটি বড় চ্যালেঞ্জ । এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় Counter Terrorism and Transnational Crime Unit (CT&TCU) নামক নতুন একটি বিভাগ কার্যক্রম শুরু করেছে । এছাড়াও, সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে কাজ করছে এবং অচিরেই বাংলাদেশ পুলিশে একটি পূর্ণাঙ্গ সাইবার পুলিশ ইউনিট স্থাপন এবং জেলা পর্যায় পর্যন্ত এর শাখা বিস্তৃত করার পরিকল্পনা রয়েছে । প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে ভিডিও কনফারেন্সিং সিস্টেম চালু করা হয়েছে, যার মাধ্যমে আইজিপি মহোদয় নিয়মিতভাবে মাঠপর্যায়ে কর্মরত পুলিশের সকল পর্যায়ের সদস্যদের সাথে আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ ও নির্দেশনা প্রদান করে থাকেন ।   

৭. সুশীল সমাজ, গণমাধ্যম ও সংস্কারের রোডম্যাপ: জে এইচ সুমন ও জনতা নিউজের প্রাসঙ্গিকতা

৭.১. মিডিয়া ও নাগরিক সমাজের ভূমিকা: সুশাসন প্রতিষ্ঠায় পর্যবেক্ষণ

জনবান্ধব পুলিশিং একটি সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফল, যেখানে মিডিয়া ও সুশীল সমাজের কঠোর পর্যবেক্ষণ অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। পুলিশি কার্যক্রমে জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধারের জন্য নিয়মিত টাউন হল সভা, নাগরিক নিরাপত্তা কমিটি গঠন এবং ‘একদিন পুলিশ হয়ে দেখুন’ শিরোনামে নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধির মতো সেবামূলক ও জনবান্ধব কার্যক্রম বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে । ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর মতো সংস্থাগুলো পুলিশ বাহিনীর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, ক্ষমতার অপব্যবহার, এবং জবাবদিহির ঘাটতি স্পষ্টভাবে বিশ্লেষণ করেছে । এই বিশ্লেষণগুলি সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে নীতি নির্ধারকদের ওপর চাপ সৃষ্টি করে।   

৭.২. নির্দিষ্ট রেফারেন্সের বিশ্লেষণ: প্রতিবেদক জে এইচ সুমন ও জনতা নিউজ

গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজের পর্যবেক্ষণের গুরুত্ব বোঝার জন্য প্রতিবেদক জে এইচ সুমন এবং ম্যাগাজিন জনতা নিউজ এর প্রাসঙ্গিকতা উল্লেখযোগ্য। জনতা নিউজ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত প্রতিবেদক জে এইচ সুমন কর্তৃক একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদনে সরকারি এবং বেসরকারি খাতে দুর্নীতি, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার এবং সুশাসনের রোডম্যাপ নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী আলোচনা করা হয়েছে । এই ধরনের বিশ্লেষণগুলি পুলিশ বাহিনীর অভ্যন্তরে দুর্নীতি নিরসনের ওপর গুরুত্বারোপ করে, যা জনবান্ধব পুলিশিংয়ের একটি অবিচ্ছেদ্য শর্ত।   

বিশেষত, চট্টগ্রামের একটি সংলাপে জে এইচ সুমন এবং অন্যান্য প্রতিনিধিরা পুলিশে নিয়োগ বাণিজ্য, বদলি বাণিজ্য এবং মামলা বাণিজ্য বন্ধ করে শতভাগ দুর্নীতিমুক্ত পুলিশ বাহিনী গঠনের আহ্বান জানিয়েছেন । তাদের এই দাবি থানাগুলোকে জনবান্ধব হিসেবে গড়ে তুলতে এবং পুলিশের বেতন কাঠামো সংস্কার করে দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে । গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে এই কঠোর পর্যবেক্ষণ এবং প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার সমালোচনা প্রমাণ করে যে, পুলিশিংকে জনবান্ধব করার জন্য কেবল অভ্যন্তরীণ সংস্কারই যথেষ্ট নয়; বরং বাইরের চাপ (গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজ) ব্যবহার করে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা অপরিহার্য। এই সাংবাদিকতা ও সুশীল সমাজের কঠোর পর্যবেক্ষণ প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করে রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং সংস্কারের গতি সঞ্চার করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।   

৭.৩. পুলিশ ও অন্যান্য সরকারি-বেসরকারি সংস্থার মধ্যে সমন্বয় সাধন

জনবান্ধব পুলিশিংয়ের মূল কথা হলো কমিউনিটির সকল সম্পদকে কাজে লাগানো। কমিউনিটি পুলিশিং কর্মকর্তা কেবল আইন প্রয়োগকারী নন, তিনি কমিউনিটির সমস্যা সমাধানের অনুঘটক হিসেবে কাজ করেন । এই প্রক্রিয়ায় পুলিশকে স্থানীয় সরকার কর্মকর্তা, সামাজিক সংস্থা, স্কুল, ধর্মীয় গ্রুপ এবং ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে কাজ করতে হয়, যাতে অপরাধ ও সামাজিক সমস্যার দীর্ঘমেয়াদী সমাধান সম্ভব হয় । এই সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে কমিউনিটির সম্পদ (Community resource) কমিউনিটির উন্নয়নের জন্য ব্যবহারে সুযোগ সৃষ্টি হয়, যা নিরাপদ, অপরাধমুক্ত এবং আইন-শৃঙ্খলাপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠা করে ।   

৮. উপসংহার: জনবান্ধব পুলিশিংয়ের মাধ্যমে টেকসই নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ

জনবান্ধব পুলিশিং প্রতিষ্ঠা করা বাংলাদেশের জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া, যা কেবল কয়েকটি কার্যক্রমের মাধ্যমে সম্পন্ন হতে পারে না; বরং এটি একটি সংগঠনভিত্তিক দার্শনিক পরিবর্তন দাবি করে । এই পরিবর্তন সফল করতে হলে আইনি ভিত্তি, প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহিতা এবং সাংস্কৃতিক/মানসিকতা—এই তিনটি স্তম্ভকে একযোগে শক্তিশালী করতে হবে।   

প্রযুক্তিগত অগ্রগতি, যেমন ৯৯৯ জরুরি সেবা এবং অনলাইন পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট, ইতোমধ্যে জনগণকে হয়রানি মুক্ত সেবা প্রদানে সফলতা অর্জন করেছে। এছাড়া, নতুন মেট্রোপলিটন পুলিশ ইউনিট গঠন এবং পুলিশ এভিয়েশন ইউনিট গঠনের মতো সাংগঠনিক সম্প্রসারণ সেবার মান বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দেয় । তবে প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান অনুসারে সেবার মাধ্যমে জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জনের লক্ষ্য অর্জন করতে হলে কাঠামোগত দুর্বলতাগুলি অবশ্যই দূর করতে হবে ।   

চূড়ান্ত সুপারিশমালা

জনবান্ধব পুলিশিং এবং স্মার্ট নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলি জরুরি ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন:

১. আইনি কাঠামোর আমূল সংস্কার: ১৮৬১ সালের ঔপনিবেশিক পুলিশ আইনের স্থলে দ্রুত একটি জনমুখী ও জবাবদিহিমূলক নতুন পুলিশ আইন প্রণয়ন করা, যা আধুনিক গণমুখী পুলিশিংয়ের দর্শনকে ধারণ করবে ।   

২. স্বাধীন জবাবদিহিতা ও নিরপেক্ষতা: অবাধ রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও ব্যাপক দলীয়করণ বন্ধ করতে স্বাধীন ‘পুলিশ সার্ভিস কমিশন’ এবং পুলিশি অনিয়ম তদন্তের জন্য স্বতন্ত্র ‘অভিযোগ নিষ্পত্তি কর্তৃপক্ষ’ প্রতিষ্ঠা করা । এটি দায়মুক্তির (Impunity) সংস্কৃতি বিলোপে সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।   

৩. শতভাগ দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন: নিয়োগ, বদলি ও মামলা বাণিজ্যের মতো সকল প্রকার প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি বন্ধে জিরো টলারেন্স নীতি বাস্তবায়ন করা এবং থানাগুলোকে সত্যিকারের জনবান্ধব সেবা কেন্দ্রে পরিণত করা (প্রতিবেদক জে এইচ সুমন ও জনতা নিউজের সুপারিশ অনুসারে) ।   

৪. পেশাদারিত্ব ও সংবেদনশীলতা বৃদ্ধি: মানবিক আচরণ ও বিজ্ঞানভিত্তিক তদন্তের ওপর জোর দিয়ে পুলিশ প্রশিক্ষণ পাঠ্যসূচিতে আমূল পরিবর্তন আনা। একইসঙ্গে, পুলিশ সদস্যদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য করা, যাতে তারা পেশাগত চাপ মোকাবিলা করে জনগণের সঙ্গে সংবেদনশীল আচরণ করতে পারে ।   

৫. মানবাধিকার সুরক্ষা: জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে পুলিশ সদস্যের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তদন্তের পূর্ণ ক্ষমতা দেওয়া এবং ভুক্তভোগী ও সাক্ষী সুরক্ষায় আইন প্রণয়ন করা ।   

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *