নোয়াখালী বিভাগ: ইতিহাস, যৌক্তিকতা, এবং বিশ্ব প্রেক্ষাপটে এক কোটি মানুষের মর্যাদার লড়াই
নোয়াখালী বিভাগ চাই, নোয়াখালী বিভাগ বাস্তবায়ন আন্দোলন, নোয়াখালীর ইতিহাস, বিভাগ দাবীর যৌক্তিকতা, জে এইচ সুমন, জনতা নিউজ।
প্রথম অধ্যায়: পটভূমি ও বিশ্লেষণ
১.১. কেন নোয়াখালী বিভাগ সময়ের দাবি?
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী জনপদ বৃহত্তর নোয়াখালীকে নিয়ে একটি স্বতন্ত্র প্রশাসনিক বিভাগ (নোয়াখালী বিভাগ) প্রতিষ্ঠার দাবিটি দেশের বহুল আলোচিত আন্দোলনগুলোর মধ্যে অন্যতম। এই দাবি শুধুমাত্র প্রশাসনিক সুবিধা বা অবকাঠামোগত উন্নয়নের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি বৃহত্তর নোয়াখালী অঞ্চলের প্রায় এক কোটি মানুষের (আন্দোলনকারীদের দাবি অনুযায়ী) দীর্ঘদিনের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য এবং জাতীয় অর্থনীতিতে বিপুল অবদানের স্বীকৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত একটি “মর্যাদার লড়াই”। স্থানীয় জনগণের দাবি, তাদের আঞ্চলিক উপভাষা, কৃষ্টি ও ঐতিহ্যের স্বীকৃতি নিশ্চিত করার জন্য এই প্রশাসনিক স্বায়ত্তশাসন অপরিহার্য।
বিগত এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে এই দাবির চেতনা স্থানীয় মানুষের মধ্যে প্রোথিত থাকলেও, সাম্প্রতিক সময়ে প্রস্তাবিত কুমিল্লা বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ঘোষণার সূত্র ধরে নোয়াখালী বিভাগ আন্দোলন আরও তীব্র হয়ে উঠেছে। এই পরিস্থিতিতে স্থানীয় জনগণ আশঙ্কা প্রকাশ করছেন যে নোয়াখালী জেলাকে বাদ দিয়ে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের নামে বিভাগ বাস্তবায়ন করা হলে তাদের স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত পরিচয় ঝুঁকির মুখে পড়বে। এই আন্দোলন একটি জটিল প্রশাসনিক রাজনীতির শিকার হয়েছে বলে নীতি বিশ্লেষকরা মনে করেন। যখনই সরকার নতুন বিভাগ গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে (যেমন কুমিল্লা বা ফরিদপুর), নোয়াখালীর আন্দোলন তখন কেবল অভ্যন্তরীণ উন্নয়ন বা বিকেন্দ্রীকরণের তাগিদ থেকে না এসে, পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের উত্থানের ফলে নিজেদের সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব হারানোর আশঙ্কায় প্রতিবাদ হিসেবে তীব্রতা পেয়েছে। এটি প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে এই অঞ্চলের দীর্ঘদিনের উপেক্ষার একটি স্পষ্ট প্রতিফলন।
১.২. প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ নীতি ও আঞ্চলিক উন্নয়ন
প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের মূল লক্ষ্য হলো জনসেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া এবং প্রশাসনিক কাজ দ্রুত নিষ্পত্তি করা। ভৌগোলিক ও যাতায়াতের সুবিধার ভিত্তিতে নতুন প্রশাসনিক ইউনিট যেমন বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা হয়। বর্তমানে নোয়াখালী জেলা চট্টগ্রাম বিভাগের অধীনে রয়েছে। বিভাগীয় সদর দপ্তর চট্টগ্রাম থেকে এ জেলার দূরত্ব প্রায় ১৩৬ কিলোমিটার এবং রাজধানী ঢাকা থেকে প্রায় ১৭১ কিলোমিটার। এই দূরত্ব প্রায়শই প্রশাসনিক কার্যাবলী, উচ্চতর আপিল ও গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্ব ঘটায়, যার ফলস্বরূপ জনসেবার মান হ্রাস পায়।
নতুন বিভাগ গঠনের প্রক্রিয়া একটি জটিল আমলাতান্ত্রিক পথ অনুসরণ করে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ স্পষ্ট জানিয়েছে যে মন্ত্রিসভা-বৈঠকের সিদ্ধান্ত ছাড়া কোনো বিভাগ গঠন করা সম্ভব নয়। এছাড়া, নতুন বিভাগ প্রতিষ্ঠা হলে যে নতুন প্রশাসনিক ও বিচারিক পদ (যেমন বিভাগীয় কমিশনার, সচিবালয় ইত্যাদি) সৃষ্টি হবে, তার জন্য রাজস্বখাতে পদ সৃজন, অস্থায়ী পদ স্থায়ীকরণ এবং পদ উন্নীতকরণের ক্ষেত্রে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও অর্থ বিভাগের কাছ থেকে ব্যাপক যৌক্তিকতা ও আর্থিক অনুমোদন নিতে হয়। উল্লেখ্য, ১৯৮২ সালে প্রশাসনিক পুনর্গঠন ও সংস্কার কমিটি যদিও বিভাগীয় কাঠামো বিলুপ্ত করার সুপারিশ করেছিল, তবে বর্তমান নীতিমালায় জনসংখ্যা, ভৌগোলিক অবস্থান এবং অর্থনৈতিক সক্ষমতাকে নতুন বিভাগ গঠনের মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
১.৩. বৃহত্তর নোয়াখালী: ভৌগোলিক অবস্থান ও জনসংখ্যাগত চিত্র
বৃহত্তর নোয়াখালী বলতে নোয়াখালী, ফেনী ও লক্ষ্মীপুর জেলাকে বোঝানো হয়, যা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত। এই অঞ্চলের মোট আয়তন ৪২০২.৭০ বর্গ কিলোমিটারের বেশি। নোয়াখালী জেলার অবস্থান $২২^{\circ}০৭’$ থেকে $২৩^{\circ}০৮’$ উত্তর অক্ষাংশ এবং $৯০০^{\circ}৫৩’$ থেকে $৯১^{\circ}২৭’$ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ জুড়ে বিস্তৃত। এই জেলার পূর্বে চট্টগ্রাম ও ফেনী জেলা, উত্তরে কুমিল্লা, পশ্চিমে লক্ষ্মীপুর ও ভোলা এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর অবস্থিত।
ভৌগোলিক বাস্তবতায়, নোয়াখালী একটি উপকূলীয় অঞ্চল। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই অঞ্চলের উপকূল বরাবর নতুন চর ও ডুবোচরের উত্থানের ফলে নোয়াখালীর মোট আয়তন ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা ভবিষ্যতে এটিকে “আরেক বাংলাদেশের সমান আয়তন” দেবে বলে অভিমত ব্যক্ত করা হয়েছে।
২০২২ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, বৃহত্তর নোয়াখালীর জনমিতিক চিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে শুধুমাত্র নোয়াখালী, ফেনী এবং লক্ষ্মীপুর জেলার মোট জনসংখ্যা প্রায় ৭২ লক্ষাধিক। আন্দোলনকারীরা এই অঞ্চলের মোট জনসংখ্যা প্রায় এক কোটির কাছাকাছি দাবি করেন, যা একটি কার্যকর প্রশাসনিক ইউনিট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য পর্যাপ্ত জনমিতিক ভিত্তি প্রদান করে।
১.৪. প্রতিবেদনের কাঠামো ও এসইও কৌশল
এই প্রতিবেদনটি নোয়াখালী বিভাগ বাস্তবায়ন আন্দোলনকে ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষণ করে একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র প্রদান করে। গুগলে ভাইরাল হওয়ার শর্ত পূরণের জন্য, এই প্রতিবেদনে নোয়াখালীর স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক উপাদান, শক্তিশালী অর্থনৈতিক অবদান এবং বিশেষ করে আঞ্চলিক সংঘাতের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। ‘নোয়াখালী বিভাগ চাই’ স্লোগানটির ঐতিহাসিক আবেদন এবং সাম্প্রতিক সময়ে এই আন্দোলনকে ঘিরে সৃষ্ট আঞ্চলিক বিরোধকে হাইলাইট করার মাধ্যমে সাধারণ পাঠকের আগ্রহ বৃদ্ধি করে প্রতিবেদনটির অনলাইন প্রাসঙ্গিকতা বৃদ্ধি করা হয়েছে।

দ্বিতীয় অধ্যায়: নোয়াখালীর ঐতিহাসিক পরিচয় ও স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক ভিত্তি
২.১. প্রাচীন ভুলুয়া জনপদ: বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী স্নায়ুকেন্দ্র
নোয়াখালী জেলার ইতিহাস প্রাচীন সমতট জনপদের ইতিহাসের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। এই অঞ্চলের প্রাচীন নাম ছিল ভুলুয়া। ঐতিহাসিক নথি অনুযায়ী, ভুলুয়া ছিল বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী অঞ্চলের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র, যা খ্রিস্টপূর্ব সময়েও আন্তর্জাতিক নৌ-বাণিজ্যের একটি প্রধান বন্দর হিসেবে পরিচিত ছিল। ত্রয়োদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়েও ভুলুয়া ছিল একটি স্বাধীন এলাকা, যা পরবর্তীতে দিল্লির সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলকের সাম্রাজ্যভুক্ত হয়।
ব্রিটিশ শাসনামলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস ১৭৭২ সালে এদেশে আধুনিক জেলা প্রশাসন প্রবর্তনের চেষ্টা করেন এবং তখন নোয়াখালী অঞ্চলটি কলিন্দা নামক একটি জেলার অংশ ছিল। ১৭৮৭ সালে ভুলুয়া নামে আবার জেলা প্রশাসনিক ইউনিট তৈরি হলেও এটি ১৭৯২ সালে ত্রিপুরা জেলার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। দীর্ঘ প্রক্রিয়ার পর ১৮২১ সালে ভুলুয়া নামে স্বতন্ত্র জেলা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৮৬৮ সালে এটির নাম পরিবর্তন করে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘নোয়াখালী’ নামকরণ করা হয়।
২.২. নামকরণ রহস্য: ১৬৬০ সালের ‘নোয়া খাল’ এবং ভুলুয়া থেকে নোয়াখালী যাত্রা
নোয়াখালী নামের উৎপত্তি এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জনগণের সম্মিলিত প্রতিক্রিয়ার এক ঐতিহাসিক সাক্ষী। ইতিহাসবিদদের মতে, ১৬৬০ সালের দিকে ত্রিপুরার পাহাড় থেকে প্রবাহিত ডাকাতিয়া নদীর পানিতে ভুলুয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চল ভয়াবহভাবে প্লাবিত হয় এবং এতে ফসলি জমির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এই ভয়াবহ বন্যা ও প্লাবন থেকে পরিত্রাণের উপায় হিসেবে, সেই বছর একটি বিশাল খাল খনন করা হয়, যা পানির প্রবাহকে ডাকাতিয়া নদী থেকে মেঘনা ও ফেনী নদীর দিকে প্রবাহিত করে। এই নতুন খনন করা খালটি স্থানীয় আঞ্চলিক ভাষায় ‘নোয়া খাল’ (নতুন খাল) নামে পরিচিতি লাভ করে। কালক্রমে এই ‘নোয়া খাল’ থেকেই জেলার নাম পরিবর্তিত হয়ে ‘নোয়াখালী’ হয়। এটি শুধুমাত্র একটি ভৌগোলিক নাম পরিবর্তন ছিল না, বরং প্রাকৃতিক পরিবেশের বিরুদ্ধে এই অঞ্চলের মানুষের ঐতিহাসিক প্রতিরোধের প্রতীক।
২.৩. ধর্মীয় সম্প্রীতি ও রাজনৈতিক চেতনা: ওয়াহাবী আন্দোলন, খিলাফত ও গান্ধী আশ্রমের ঐতিহাসিক ভূমিকা
নোয়াখালীর ইতিহাস জাতীয় রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণের স্বাক্ষর বহন করে। এই অঞ্চলের জনগণের ১৮৩০ সালের ওয়াহাবী আন্দোলন এবং ১৯২০ সালের খিলাফত আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
তবে নোয়াখালীর ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু ছিল ১৯৪৬ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। ভারত বিভাগের প্রাক্কালে ১৯৪৬ সালের অক্টোবরে বৃহত্তর নোয়াখালীর সর্বত্র ভয়ঙ্কর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। দাঙ্গা-পরবর্তী পরিস্থিতি সরজমিনে দেখতে এবং শান্তি ও সামাজিক সম্প্রীতির বার্তা দিতে মহাত্মা গান্ধী ‘শান্তি মিশনে’ নোয়াখালীতে ছুটে আসেন। ১৯৪৭ সালের ২৯ জানুয়ারি তিনি বেগমগঞ্জ উপজেলার জয়াগ গ্রামে পৌঁছান এবং স্থানীয় জমিদার হেমন্তকুমার ঘোষের দান করা সম্পত্তির ওপর ‘অম্বিকা-কালীগঙ্গা দাতব্য ট্রাস্ট’ (যা বর্তমানে গান্ধী আশ্রম ট্রাস্ট নামে পরিচিত) প্রতিষ্ঠা করেন। গান্ধী এই অঞ্চলে প্রায় চার মাস অবস্থান করে ৪৭টি গ্রামে ভ্রমণ এবং প্রার্থনা সভার আয়োজন করেন, যার লক্ষ্য ছিল সাম্প্রদায়িক ঐক্য ও সম্প্রীতি ফিরিয়ে আনা।
এই গভীর ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক ঐতিহ্য প্রমাণ করে যে নোয়াখালী কেবল একটি প্রাচীন প্রশাসনিক কেন্দ্র নয়, এটি জাতীয় রাজনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। যে অঞ্চল মহাত্মা গান্ধীর মতো ব্যক্তিত্বের মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল, তার জন্য একটি স্বতন্ত্র প্রশাসনিক মর্যাদা দাবি করা নৈতিক ও ঐতিহাসিক দিক থেকে যথেষ্ট শক্তিশালী ভিত্তি তৈরি করে।
২.৪. নোয়াখাইল্লা ভাষা: কৃষ্টি ও পরিচয়ের শক্তিশালী স্তম্ভ
বৃহত্তর নোয়াখালীর (নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী) জনগণের স্বতন্ত্র আঞ্চলিক উপভাষা, যা ‘নোয়াখাইল্লা আঞ্চলিক ভাষা’ বা নোয়াখালীর উপভাষা নামে পরিচিত, এই অঞ্চলের পরিচয়ের একটি শক্তিশালী স্তম্ভ। গবেষকদের দাবি অনুযায়ী, এই উপভাষাটির বয়স আনুমানিক প্রায় এক হাজার বছর।
এই উপভাষাটি কেবল নোয়াখালীর মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; ফেনী, লক্ষ্মীপুর, কুমিল্লা জেলার দক্ষিণ অংশ, চট্টগ্রামের মীরসরাই উপজেলা, সন্দ্বীপ এবং চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জ উপজেলার লোকেরাও এই ভাষায় কথা বলে। এমনকি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যেও এই উপভাষাটি ব্যবহৃত হয় এবং দক্ষিণ ত্রিপুরা জেলার ভারতীয়দের মধ্যে এটি লিঙ্গুয়া ফ্র্যাঙ্কা (Lingua Franca) হিসেবে কাজ করে। এই ভাষাগত প্রসার ও স্বাতন্ত্র্য দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় নোয়াখালীর জন্য একটি শক্তিশালী আঞ্চলিক পরিচয়ের জন্ম দিয়েছে।
২.৪.১. ভাষার প্রভাব ও আঞ্চলিক নাটকে ব্যবহার:
নোয়াখাইল্লা ভাষা বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে খুবই বিখ্যাত। এই উপভাষা নিয়ে অসংখ্য নাটক রচিত হয় এবং স্থানীয় সংবাদপত্র (যেমন লক্ষ্মীপুরটোয়েন্টিফোর) আঞ্চলিক সংবাদ প্রচার করে এই ভাষাকে আরও জনপ্রিয় করেছে। এই ভাষাভিত্তিক পরিচয় এতটাই দৃঢ় যে প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের সঙ্গে এর গভীর সংযোগ রয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবীর আবেদনে এই বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরা হয়। আবেদনে বলা হয়েছে যে নোয়াখালীকে বাদ দিয়ে কুমিল্লা বিভাগ বাস্তবায়ন হলে তা নোয়াখালীর ভাষা, শত বছরের কৃষ্টি ও সংস্কৃতির ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলবে।
এই ভাষাগত উদ্বেগ একটি গভীর রাজনৈতিক মাত্রা বহন করে। যখন প্রশাসনিক পুনর্গঠন একটি অঞ্চলের স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক পরিচয়ের ওপর চাপ সৃষ্টি করে, তখন আন্দোলনটি কেবল অবকাঠামো কেন্দ্রিক না থেকে ‘ভাষার অধিকার’ রক্ষার আন্দোলনে রূপ নেয়, যা ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক চেতনার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। এই ভাষাগত আত্মমর্যাদার লড়াই-ই বিভাগ দাবির ক্ষেত্রে সবচেয়ে আবেগপ্রবণ এবং শক্তিশালী ভিত্তি তৈরি করেছে।
তৃতীয় অধ্যায়: বিভাগ আন্দোলনের দীর্ঘ পথ পরিক্রমা ও সাংগঠনিক ভিত্তি

৩.১. চেতনার উন্মেষ: ১৯১০-এর দশকে শিক্ষিত ও ব্যবসায়ী সমাজের আহ্বান
নোয়াখালী বিভাগ বাস্তবায়ন আন্দোলনের দাবিটি নতুন নয়। ঐতিহাসিক দলিল এবং স্থানীয় গবেষকরা মনে করেন যে, প্রায় এক শতাব্দীরও বেশি সময় আগে, অর্থাৎ ১৯১০ সালের দিকেই নোয়াখালী জেলার শিক্ষিত শ্রেণি ও ব্যবসায়ী সমাজ প্রশাসনিক স্বাবলম্বিতা এবং বিকেন্দ্রীকরণের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা শুরু করেন। তাদের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল এই বৃহৎ উপকূলীয় অঞ্চলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি ও পরিবহন উন্নয়নের সুযোগ তৈরি করা। যদিও সেই সময়ে কোনো সংগঠিত আন্দোলন গড়ে ওঠেনি, তবুও এই সময়কালকেই ‘নোয়াখালী বিভাগ আন্দোলনের চেতনার সূচনালগ্ন’ হিসেবে গণ্য করা হয়।
৩.২. নব্বইয়ের দশক ও সাংগঠনিক রূপ লাভ
দীর্ঘ সময়ের নীরবতার পর ১৯৯০-এর দশকে নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থী, সমাজকর্মী ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের উদ্যোগে এই আন্দোলন নতুন করে গতি লাভ করে। ১৯৯৪ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে “নোয়াখালী বিভাগ বাস্তবায়ন পরিষদ” নামে একটি সংগঠন গঠিত হয়। এই সংগঠনের দাবির মধ্যে কেবল নোয়াখালীকে স্বতন্ত্র প্রশাসনিক বিভাগ ঘোষণা করাই ছিল না, বরং হাতিয়াকে নতুন জেলা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা এবং বাণিজ্য, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবায় সরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধির মতো ১০ দফা দাবিও অন্তর্ভুক্ত ছিল।

৩.৩. সাম্প্রতিক তীব্রতা: রাজপথ থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নোয়াখালী বিভাগ বাস্তবায়ন আন্দোলন আরও তীব্র আকার ধারণ করেছে। আন্দোলনকারীরা বিক্ষোভ, মানববন্ধন, স্মারকলিপি প্রদান, মোটরসাইকেল র্যালি এবং জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ঘেরাওয়ের মতো নানা কর্মসূচি পালন করেছেন। বিভাগ দাবির স্লোগান এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে একটি জনপ্রিয় বিষয়ে পরিণত হয়েছে, যদিও স্থানীয়দের দাবি, এই নিয়ে হাস্যরসাত্মক মন্তব্য বা মিম অন্য জেলার লোকেরাই বেশি করে থাকে।
আন্দোলনটির আধুনিক রূপ হলো, এটি শুধু রাজনৈতিক অঙ্গনেই সীমাবদ্ধ থাকেনি; কনটেন্ট ক্রিয়েটররাও এই দাবিতে মাঠে নেমেছেন। এই অনলাইন উপস্থিতি এই আন্দোলনকে সোশ্যাল মিডিয়ায় দ্রুত ছড়িয়ে দিয়েছে, যা এসইও এবং ‘ভাইরাল’ হওয়ার প্রবণতা বাড়িয়েছে।
সাম্প্রতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে, আন্দোলনটির গুরুত্ব বেড়েছে যখন বিএনপি-এর পক্ষ থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে যে তারা ক্ষমতায় এলে প্রথম অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে নোয়াখালীকে বিভাগ করবে।

৩.৪. সাম্প্রতিক আন্দোলনের চিত্রায়ন: জনতা নিউজ এবং প্রতিবেদক জে এইচ সুমনের ফোকাস
নোয়াখালী বিভাগ বাস্তবায়ন আন্দোলনের সাম্প্রতিক চিত্রায়নে সবচেয়ে আলোচিত এবং বিতর্কিত অংশটি হলো আঞ্চলিক সংঘাতের জন্ম দেওয়া। ১১ অক্টোবর ২০২৫ তারিখে নোয়াখালী বিভাগ চেয়ে আন্দোলনকারীরা ঢাকা জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন শেষে ফেরার পথে কুমিল্লার পদুয়ার বাজার বিশ্বরোড এলাকায় স্থানীয় জনতা তাদের বহনকারী বাস আটকে দেয়। এই ঘটনায় কুমিল্লা-নোয়াখালী আঞ্চলিক মহাসড়কসহ ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়কে তীব্র যানজট সৃষ্টি হয় এবং আঞ্চলিক বিরোধ প্রকাশ্যে আসে। পুলিশ এসে অবরোধকারীদের নিবৃত্ত করলেও, এই ঘটনায় দুই অঞ্চলের মানুষের মধ্যেকার চাপা উত্তেজনা প্রকাশিত হয়।
এই আঞ্চলিক সংঘাতের খবর বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার করে, যা অনলাইন মাধ্যমে আন্দোলনকে আরও বেশি প্রাসঙ্গিক করে তোলে। ম্যাগাজিন জনতা নিউজ এবং প্রতিবেদক জে এইচ সুমন এই ঘটনার ওপর একাধিক বিশ্লেষণাত্মক প্রতিবেদন তৈরি করেন, যেখানে নোয়াখালী ও কুমিল্লার জনগণের মধ্যেকার প্রশাসনিক বিভাজন নিয়ে বিদ্যমান বিরোধ এবং আঞ্চলিক উত্তেজনার বিষয়টি বিস্তারিতভাবে উঠে আসে। এই ধরনের কাভারেজ, যেখানে আন্দোলন এবং পালটা আন্দোলন দেখানো হয়, তা সোশ্যাল মিডিয়ায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
প্রশাসনিক পুনর্গঠনের দাবি যখন আঞ্চলিক সংঘাতের জন্ম দেয়, তখন তা কেবল স্থানীয় রাজনীতিতে সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং মিডিয়াতে উচ্চ ক্লিক-রেট (CTR) এবং দ্রুত প্রচারের একটি বিষয় হয়ে ওঠে। মিডিয়া সংস্থাগুলি, যেমন জনতা নিউজ, এবং সাংবাদিকদের রিপোর্টিং এই বিরোধকে পুঁজি করে প্রতিবেদনটিকে আরও বেশি প্রাসঙ্গিক ও ‘ভাইরাল’ করে তুলতে পারে। এটি প্রমাণ করে যে বিভাগ আন্দোলন এখন আর শুধু সরকারি নথিপত্রের বিষয় নয়, এটি একটি পাবলিক স্পেক্টাকেল, যা এসইও এবং ভাইরাল কন্টেন্ট তৈরির জন্য অপরিহার্য।
চতুর্থ অধ্যায়: নোয়াখালী বিভাগ দাবীর অকাট্য যৌক্তিকতা (The Core Rationale)
নোয়াখালী বিভাগ দাবীর মূল যৌক্তিকতা প্রশাসনিক, জনমিতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক—এই চারটি প্রধান স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে আছে।
৪.১. প্রশাসনিক দূরত্ব ও জনসেবা প্রদান
নোয়াখালী জেলা যেহেতু চট্টগ্রাম বিভাগীয় সদরের কেন্দ্র থেকে প্রায় ১৩৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত 4, তাই জেলার প্রশাসনিক কার্যাবলী, গুরুত্বপূর্ণ ফাইল অনুমোদন, এবং স্থানীয় সরকার সংক্রান্ত উচ্চতর আপিল দ্রুত নিষ্পত্তি করা কঠিন হয়ে পড়ে। প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ স্থানীয় জনগণের সমস্যা দ্রুত নিরসনে এবং মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতা বাড়াতে সাহায্য করে। একটি নতুন বিভাগীয় সদর দপ্তর প্রতিষ্ঠা হলে এই অঞ্চলের জনগণ সহজেই উচ্চ পর্যায়ের প্রশাসনিক পরিষেবা গ্রহণ করতে পারবে।
৪.২. জনমিতি ও ভৌগোলিক বাস্তবতা: একটি বিভাগ গঠনের মানদণ্ড
বাংলাদেশের প্রশাসনিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি নতুন বিভাগ গঠনের জন্য পর্যাপ্ত আয়তন এবং বিশাল জনসংখ্যা একটি গুরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্ত। বৃহত্তর নোয়াখালী অঞ্চলের বিশাল জনসমষ্টি এবং এর আয়তন একটি স্বাধীন বিভাগ পরিচালনার জন্য যথেষ্ট ভিত্তি তৈরি করে।
নিম্নোক্ত সারণিটি বৃহত্তর নোয়াখালী (নোয়াখালী, ফেনী ও লক্ষ্মীপুর) অঞ্চলের জনমিতিক চিত্র তুলে ধরে:
বৃহত্তর নোয়াখালী বিভাগের প্রস্তাবিত অঞ্চলের জনমিতিক চিত্র (২০২২ আদমশুমারি অনুযায়ী)
| জেলা | মোট জনসংখ্যা (২০২২) | আয়তন (বর্গ কি.মি.) | তথ্যসূত্র |
| নোয়াখালী | ৩,৬২৫,৪৪২ | ৩,৬৮৫.৮৭ | 7 |
| ফেনী | ১,৬৪৮,৮৯৬ | ১,৪০৭.৯৮ | 7 |
| লক্ষ্মীপুর | ১,৯৩৮,১১১ | ১,৪৫৬.০৪ | 7 |
| মোট (বৃহত্তর নোয়াখালী) | ৭২,১১,৪৪৯+ | ৬,৫৪৬.৮৯+ | 2 |
এই বিশাল জনসংখ্যা (প্রায় ৭.২ মিলিয়ন, যদিও আন্দোলনকারীরা প্রায় ১ কোটি দাবি করেন 2) যদি শুধুমাত্র একটি মাত্র বিভাগীয় সদরের (চট্টগ্রাম) অধীনে থাকে, তবে জনসেবা প্রদান, তদারকি এবং উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন কঠিন হয়ে পড়ে। উপরন্তু, নোয়াখালী একটি উপকূলীয় জেলা হওয়ায় ডুবোচরগুলো চরে পরিণত হয়ে এর আয়তন ক্রমাগত বাড়ছে 2। এই ৭ মিলিয়নেরও বেশি জনসংখ্যা এবং ভৌগোলিকভাবে বর্ধনশীল ভূখণ্ড একটি স্বাধীন প্রশাসনিক ইউনিট হিসেবে বিবেচিত হওয়ার জন্য যথেষ্ট এবং এটি প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের মূল নীতির সঙ্গে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ।
৪.৩. রেমিট্যান্স নির্ভর অর্থনীতি: জাতীয় অর্থনীতিতে নীরব অবদান
নোয়াখালী বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একটি নীরব কিন্তু অত্যন্ত শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে। এই জেলা দেশের শীর্ষ রেমিট্যান্স পাঠানো জেলাগুলোর মধ্যে অন্যতম। জেলার মোট আয়ের প্রায় ৮% সরাসরি রেমিট্যান্স খাত থেকে আসে। এই বিপুল রেমিট্যান্স প্রবাহ জাতীয় জিডিপির একটি গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি।
এছাড়াও, নোয়াখালীর অর্থনীতি মূলত কৃষি নির্ভর। আঞ্চলিক জিডিপির প্রায় ৪০% কৃষি খাত থেকে আসে। এই অঞ্চলের ৮০ ভাগ মানুষ কৃষির সাথে জড়িত, যেখানে মৎস্য চাষ ও মৎস্য আহরণের ভূমিকা অত্যন্ত বিশাল। আইনজীবীর আবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ২০২২ সালের খানা তথ্যানুযায়ী নোয়াখালীতে সবচেয়ে কম দরিদ্র লোক বসবাস করে, যা এই জেলাকে বাংলাদেশের সবচেয়ে ধনী জেলাগুলোর মধ্যে স্থান দিয়েছে।
উচ্চ রেমিট্যান্স প্রবাহ নোয়াখালীর মানুষের ব্যক্তিগত অর্থনৈতিক সক্ষমতাকে নির্দেশ করে। তবে বিশ্লেষণে দেখা যায়, এই ব্যক্তিগত অর্থ স্থানীয়ভাবে শিল্প কারখানা বা বৃহৎ অবকাঠামো উন্নয়নে (যার অভাব রয়েছে) সম্পূর্ণ বিনিয়োগ হচ্ছে না, কারণ প্রশাসনিক নজরদারি তুলনামূলকভাবে কম। বিভাগ প্রতিষ্ঠা হলে স্থানীয় অর্থনীতিকে কেন্দ্র করে উন্নত অবকাঠামো গড়ে উঠবে এবং রেমিট্যান্সের সদ্ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি হবে, যা জাতীয় উন্নয়নে আরও গতি আনবে।
৪.৪. উপকূলীয় ব্যবস্থাপনা ও জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন
নোয়াখালী জেলা একটি অত্যন্ত সংবেদনশীল উপকূলীয় অঞ্চল, যা ঘূর্ণিঝড়, বন্যা এবং সাইক্লোনের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে বহুবার পতিত হয়েছে। ১৯৭০ সালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়েও এই জেলার বিপুল সংখ্যক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
উপকূলীয় পরিবেশের দ্রুত পরিবর্তন (নতুন চর গঠন) এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় দ্রুত ও কার্যকরী আঞ্চলিক পরিকল্পনা অপরিহার্য। উপকূলীয় জেলার জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা একটি স্বতন্ত্র ও উচ্চ অগ্রাধিকারের বিষয়, যা চট্টগ্রাম বিভাগের বৃহৎ প্রশাসনিক কাঠামো থেকে দ্রুত সাড়া পেতে বিলম্ব হতে পারে। একটি স্বতন্ত্র বিভাগ প্রতিষ্ঠা হলে উপকূলীয় ব্যবস্থাপনা, নব-গঠিত চরভূমির প্রশাসন ও ভূমি বন্দোবস্ত দ্রুত ও কার্যকরভাবে নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। এটি প্রশাসনিক দিক থেকে অঞ্চলটিকে স্বায়ত্তশাসন দেবে, যা দুর্যোগ মোকাবেলায় সক্ষমতা বাড়াবে।
পঞ্চম অধ্যায়: প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস ও বিশ্ব অভিজ্ঞতা (Global Case Studies)
৫.১. বিভাগ গঠনের রাষ্ট্রীয় প্রক্রিয়া: মন্ত্রিপরিষদ ও অর্থ বিভাগের শর্তাবলী
নতুন বিভাগ গঠনের প্রক্রিয়াটি বাংলাদেশের সরকার কাঠামোতে সুনির্দিষ্ট আমলাতান্ত্রিক স্তর অনুসরণ করে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ স্পষ্ট জানিয়েছে যে মন্ত্রিসভা-বৈঠকের সিদ্ধান্ত ছাড়া কোনো বিভাগ গঠন করা সম্ভব নয়। প্রশাসনিক উন্নয়নের জন্য পদ সৃজন এবং রাজস্বখাতে অস্থায়ী পদের স্থায়ীকরণের ক্ষেত্রে কঠোর সরকারি নীতিমালা অনুসরণ করতে হয়। এ ক্ষেত্রে প্রস্তাবটি প্রথমে প্রশাসনিক মন্ত্রণালয় থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে যায় এবং সেখান থেকে সম্মতি পাওয়ার পর অর্থ বিভাগে পাঠানো হয়। অর্থ বিভাগের সম্মতি ছাড়া নতুন কোনো আর্থিক দায় সৃষ্টি করা যায় না।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ভূমিকা
নোয়াখালী বিভাগ বাস্তবায়ন আন্দোলনের নেতারা সম্প্রতি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এই বৈঠকে বৃহত্তর নোয়াখালীর নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট এবং জাতীয় অর্থনীতিতে তাদের অবদান গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরা হয়। ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ, অর্থনীতিবিদ ড. ইফতেখারুজ্জামানসহ কমিশনের অন্যান্য সদস্যরা এই দাবির যৌক্তিকতা স্বীকার করেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, কমিশন সরকারকে বিভাগ গঠনের আগে সংশ্লিষ্ট জেলাগুলোতে গণশুনানি আয়োজন করার জন্য সুপারিশ করেছে, যাতে জনগণের মতামত যাচাই করা যায়। এই সুপারিশটি আন্দোলনকারীদের দাবির গুরুত্ব এবং প্রশাসনিক পর্যায়ে এর গ্রহণযোগ্যতার ইঙ্গিত বহন করে।
৫.২. বিশ্বজুড়ে প্রশাসনিক অঞ্চল পুনর্গঠন: Identity-Based Decentralization
বিশ্বজুড়ে প্রশাসনিক ইউনিট (Administrative Unit Proliferation) সৃষ্টির কারণগুলো প্রায়শই ভৌগোলিক সুবিধা, জনমিতি এবং জাতিগত বা সাংস্কৃতিক পরিচয়ের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়। নোয়াখালী বিভাগ দাবির ক্ষেত্রে এই আন্তর্জাতিক নজিরগুলো বিশেষ প্রাসঙ্গিকতা বহন করে।
৫.২.১. ভারত: তেলেঙ্গানা মডেল (সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য নিরসন)
ভারতের অন্ধ্র প্রদেশ রাজ্য ভেঙে পৃথক তেলেঙ্গানা রাজ্য গঠনের সিদ্ধান্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক নজির 27। তেলেঙ্গানা গঠনের প্রধান কারণগুলোর মধ্যে ছিল অঞ্চলের স্বতন্ত্র সংস্কৃতি, দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক দাবি এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য। প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে অঞ্চলের অর্থনৈতিক ক্ষমতা এবং প্রশাসনিক মনোযোগ নিশ্চিত করাই ছিল এই পদক্ষেপের লক্ষ্য।
তেলেঙ্গানা মডেল একটি সফল উদাহরণ যেখানে একটি বৃহৎ প্রশাসনিক ইউনিটকে বিভক্ত করা হয়েছে স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক দাবির ভিত্তিতে। এই নজিরটি নোয়াখালীর দাবির জন্য আন্তর্জাতিক আইনি ও রাজনৈতিক ভিত্তি তৈরি করে। নোয়াখালী দাবি করে যে তাদের আন্দোলন তেলেঙ্গানার মতো ‘সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যের’ ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত, যা বৃহত্তর চট্টগ্রামের অধীনে থাকার কারণে ভাষা ও অর্থনীতির গুরুত্ব হারানোর ভয় থেকে উদ্ভূত। এই ধরণের ‘সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য’ ভিত্তিক প্রশাসনিক পুনর্গঠন বৈশ্বিক নীতিতে স্বীকৃত।
৫.২.২. ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইন: প্রশাসনিক জোট ও বিকেন্দ্রীকরণ
ইন্দোনেশিয়াতে নতুন প্রদেশ সৃষ্টিতে জাতীয় এবং স্থানীয় স্তরের রাজনৈতিক অভিনেতাদের জোট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। একইভাবে, ফিলিপাইনেও আঞ্চলিক এবং স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করতে বহুস্তরীয় প্রশাসনিক বিভাগ বিদ্যমান।
এই আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা থেকে বোঝা যায় যে কেবল যৌক্তিকতা যথেষ্ট নয়; কেন্দ্র ও স্থানীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তিগুলির (আন্দোলন বাস্তবায়ন পরিষদ, জেলা সমিতি, সরকার দল) ঐকমত্যের ভিত্তিতেই প্রশাসনিক পুনর্গঠন সম্ভব। নোয়াখালী বিভাগ বাস্তবায়নের জন্য স্থানীয় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ফলপ্রসূ আলোচনা প্রমাণ করে যে, এই দাবি আন্তর্জাতিক নজিরের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে রাজনৈতিক লবিং পর্যায়ে পৌঁছেছে এবং স্থানীয় জনসমর্থন জাতীয় প্রশাসনিক কেন্দ্রবিন্দুতে মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে।
ষষ্ঠ অধ্যায়: চ্যালেঞ্জ, সুপারিশ ও উপসংহার
৬.১. আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং বিভাজন সংকট (কুমিল্লা বিতর্ক)
নোয়াখালী বিভাগ বাস্তবায়ন আন্দোলনের পথে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের সঙ্গে বিদ্যমান আঞ্চলিক সংঘাত। বিশেষ করে, কুমিল্লা বিভাগ প্রতিষ্ঠার দাবির সঙ্গে নোয়াখালীর দাবি সাংঘর্ষিক হয়ে উঠেছে। এই বিরোধ এতটাই তীব্র যে নোয়াখালী বিভাগ চেয়ে আন্দোলনকারীরা ঢাকা থেকে ফেরার পথে কুমিল্লার পদুয়ার বাজার এলাকায় স্থানীয় জনতা তাদের বাস আটকে দেয়। এই ঘটনায় স্পষ্ট হয় যে, এই প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক উত্তেজনার জন্ম দিয়েছে, যা দ্রুত প্রশমিত করা না হলে দীর্ঘমেয়াদী আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হতে পারে।
৬.২. বিভাগ বাস্তবায়নের পথে আমলাতান্ত্রিক ও আর্থিক চ্যালেঞ্জসমূহ
একটি নতুন বিভাগ প্রতিষ্ঠার জন্য একাধিক প্রশাসনিক ও আর্থিক ধাপ অতিক্রম করতে হয়। নতুন বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়, নতুন সচিবালয়, এবং অন্যান্য প্রশাসনিক ও বিচারিক পদ (১৮৭৭ সালে প্রতিষ্ঠিত নোয়াখালী জেলা ও দায়রা জজ আদালত সহ অন্যান্য অফিসগুলোর উন্নয়ন) তৈরির জন্য বিশাল আর্থিক বিনিয়োগ প্রয়োজন। মন্ত্রিসভা-বৈঠক এবং অর্থ বিভাগকে অবশ্যই এই বিশাল আর্থিক সংশ্লেষ অনুমোদনের যৌক্তিকতা প্রমাণ করতে হবে। মন্ত্রিসভা-বৈঠকের সিদ্ধান্ত ছাড়া কোনো বিভাগ গঠন করা সম্ভব নয় মর্মে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ কর্তৃক আইনজীবীর আবেদন ফেরত দেওয়া এই আমলাতান্ত্রিক চ্যালেঞ্জকেই নির্দেশ করে।
৬.৩. বিশেষজ্ঞ সুপারিশমালা (নীতি প্রণয়ন এবং দ্রুত বাস্তবায়ন)
নোয়াখালীর দীর্ঘদিনের এই দাবিকে কার্যকর প্রশাসনিক সমাধানে নিয়ে আসার জন্য নিম্নলিখিত সুপারিশগুলো বিবেচনা করা যেতে পারে:
১. গণশুনানি এবং জনমতের প্রাধান্য নিশ্চিতকরণ: জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী, সরকারকে দ্রুত বৃহত্তর নোয়াখালী ও কুমিল্লা অঞ্চলে ব্যাপক গণশুনানির ব্যবস্থা করতে হবে এবং স্থানীয় জনগণের মতামতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। প্রশাসনিক বিভাজন যেন জনমতের ভিত্তিতে হয়, রাজনৈতিক প্রভাবের ভিত্তিতে নয়, তা নিশ্চিত করা জরুরি।
২. ‘নোয়াখালী বিভাগ’ ও ‘কুমিল্লা বিভাগ’ যুগপৎ অনুমোদন: আঞ্চলিক সংঘাত এবং দীর্ঘদিনের বিতর্ক এড়াতে, যদি প্রশাসনিক ও আর্থিক মানদণ্ড পূরণ হয়, তবে একই সঙ্গে দুটি বিভাগ (নোয়াখালী এবং কুমিল্লা) বাস্তবায়নের ঘোষণা দেওয়া উচিত। এটি আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনবে এবং উভয় অঞ্চলের জনগণের দীর্ঘদিনের মর্যাদার আকাঙ্ক্ষা পূরণ করবে।
৩. উপকূলীয় প্রশাসনিক মডেল প্রতিষ্ঠা: নোয়াখালীকে জলবায়ু পরিবর্তন ও চর উন্নয়নের কারণে একটি বিশেষায়িত প্রশাসনিক ইউনিট হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। এটিকে উপকূলীয় জলবায়ু ও চর উন্নয়ন সংক্রান্ত একটি স্বতন্ত্র প্রশাসনিক মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা যেতে পারে, যা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং নব-গঠিত ভূখণ্ডের সুষম প্রশাসনে গতি আনবে।
৬.৪. উপসংহার: বিভাগ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বৃহত্তর নোয়াখালীর সম্ভাবনা উন্মোচন
নোয়াখালী বিভাগ বাস্তবায়ন আন্দোলন বৃহত্তর নোয়াখালীর জনগণের জন্য কেবল উন্নত প্রশাসনিক সেবার দাবি নয়; এটি এক ঐতিহাসিক জনপদের বহু শতাব্দীর ঐতিহ্য, অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা এবং স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক আত্মমর্যাদার স্বীকৃতি 1। ভুলুয়া থেকে নোয়াখালীতে রূপান্তরিত এই প্রাচীন জেলাটি ওয়াহাবী আন্দোলন থেকে শুরু করে মহাত্মা গান্ধীর শান্তি মিশন পর্যন্ত জাতীয় ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এই অঞ্চল জাতীয় অর্থনীতিতে বিপুল রেমিট্যান্সের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে এবং উপকূলীয় অঞ্চলের দ্রুত পরিবর্তনশীল ভূ-প্রকৃতির কারণে বিশেষ প্রশাসনিক মনোযোগ দাবি করে।
বৃহত্তর নোয়াখালীর প্রায় এক কোটি মানুষের এই প্রাণের দাবি (নোয়াখালী বিভাগ চাই), যা ভাষা, সংস্কৃতি ও অর্থনীতিতে বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় অবস্থান দখল করে আছে, তা অচিরেই জাতীয় নীতির কেন্দ্রে আসা উচিত। প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে এই অঞ্চলের মানুষের প্রত্যাশা পূরণ এবং তাদের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা উন্মোচন করা জাতীয় স্বার্থে অপরিহার্য।

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী জনপদ বৃহত্তর নোয়াখালীকে নিয়ে একটি স্বতন্ত্র প্রশাসনিক বিভাগ (নোয়াখালী বিভাগ) প্রতিষ্ঠার দাবিটি দেশের বহুল আলোচিত আন্দোলনগুলোর মধ্যে অন্যতম।