বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের সংকট: কারণ, প্রভাব ও সমাধান বিশ্লেষণ

বাংলাদেশের ব্যাংক খাত: ‘৫ লাখ কোটি’ টাকার বিষফোঁড়া, কেন এই অস্থিরতা? – জে এইচ সুমন ও জনতা নিউজের অনুসন্ধানে উঠে আসা নেপথ্যের কারণ এবং আমূল সংস্কারের বাস্তবসম্মত পথনকশা।

প্রতিবেদক: জে এইচ সুমন (জনতা নিউজ ম্যাগাজিন)

১. মুখবন্ধ ও সারসংক্ষেপ: অস্থিরতার সংজ্ঞা, গভীরতা এবং জরুরি পদক্ষেপ

১.১. ভূমিকাতে অস্থিরতার সংজ্ঞা

বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টরে বর্তমান যে অস্থিরতা বিরাজ করছে, তা কেবল ঋণের তারল্য সংকট বা সাময়িক আর্থিক দুর্বলতার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি মূলত একটি পদ্ধতিগত ঝুঁকির (Systemic Risk) বহিঃপ্রকাশ, যেখানে খেলাপি ঋণের লাগামহীন উল্লম্ফন, সুশাসনের চূড়ান্ত পতন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুর্বল তদারকি এবং আমানতকারীদের আস্থাহীনতা সম্মিলিতভাবে দেশের আর্থিক ভিত্তিকে হুমকির মুখে ফেলেছে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের ব্যাংক খাতকে ‘নষ্ট রাজনীতির শিকার’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে । এই অস্থিরতা দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি, বিনিয়োগ পরিবেশ এবং প্রবৃদ্ধির গতিকে শ্লথ করে দিচ্ছে। এটি এমন এক গুরুতর পরিস্থিতি তৈরি করেছে, যেখানে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে আমূল সংস্কার এবং রাজনৈতিক অঙ্গীকার ছাড়া পরিত্রাণ পাওয়া প্রায় অসম্ভব।   

১.২. মূল ডেটা এবং সারসংক্ষেপ (Executive Summary)

দেশের ব্যাংকিং সেক্টরের বর্তমান সংকটের ভয়াবহতা স্পষ্ট হয় খেলাপি ঋণের (Non-Performing Loan বা NPL) সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানে। সরকারি হিসাবে, ২০২৪ সালের জুনে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৩০ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা, যা গত বছরের জুন মাসের তুলনায় ৩ লাখ ১৯ হাজার ৩৭ কোটি টাকা বেশি । এক বছরে খেলাপি ঋণের এই নজিরবিহীন বৃদ্ধি বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মানদণ্ডেও চরম উদ্বেগজনক এবং একে ব্যাংকিং খাতের ‘বিষফোঁড়া’ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে, নামে-বেনামে ব্যাংক থেকে যে বিপুল অর্থ বের করে নেওয়া হয়েছিল, আন্তর্জাতিক মানে ঋণ শ্রেণিকরণের নিয়ম কঠোর করার কারণে সেই অর্থ এখন খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে ।   

সংকটের প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা খর্ব, এবং ঋণ লুটপাটের সংস্কৃতি। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, আইনি জবাবদিহিতা কঠোর করা এবং অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি (AMC) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দ্রুত ঋণ পুনরুদ্ধারের উদ্যোগ নেওয়া। আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক এবং দেশের শীর্ষ অর্থনীতিবিদগণ এই সংস্কারের ওপর জোর দিয়েছেন ।   

২. সংকটের পরিমাণগত চিত্র: খেলাপি ঋণের মহাবিপর্যয় ও লুকানো ভার

২.১. খেলাপি ঋণের ঐতিহাসিক উল্লম্ফন (The NPL Catapult)

বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের বৃদ্ধি এক বছরের ব্যবধানে একটি মহাবিপর্যয়ের জন্ম দিয়েছে। ২০২৪ সালের জুনে খেলাপি ঋণের পরিমাণ রেকর্ড পরিমাণ ৫,৩০, ৪২৮ কোটি টাকায় পৌঁছায়, যেখানে ২০২৩ সালের জুনে এই অঙ্ক ছিল ২,১১, ৩৯১ কোটি টাকা । এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ৩ লাখ ১৯ হাজার ৩৭ কোটি টাকা । এই উল্লম্ফন ব্যাংকিং ব্যবস্থার দুর্বল নিয়ন্ত্রণ এবং বিগত বছরগুলোতে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত অনিয়মিত ঋণ বিতরণের গভীরতা প্রকাশ করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন যে পূর্ববর্তী সরকারের আমলে ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে যে অর্থ বের করা হয়েছিল, আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে খেলাপি ঋণ চিহ্নিত করার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ায় সেই ঋণগুলো এখন হিসাবে আসছে ।   

স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণের উদ্দেশ্যে ঋণ শ্রেণীকরণের নিয়ম আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার ফলেই এই বিশাল অঙ্ক দৃশ্যমান হয়েছে, যা প্রমাণ করে যে দীর্ঘ সময় ধরে ব্যাংক খাতের প্রকৃত স্বাস্থ্য লুকিয়ে রাখা হয়েছিল।

সারণী ১: ২০২৪ সালে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের (NPL) উল্লম্ফন (কোটি টাকায়)

সময়কাল খেলাপি ঋণের পরিমাণ (কোটি টাকা) মোট ঋণের শতাংশ বৃদ্ধি (এক বছরে) সূত্র
জুন ২০২৪ ৫,৩০, ৪২৮ N/A (উচ্চ) +৩,১৯,০৩৭+ বাংলাদেশ ব্যাংক (বিবি)
মার্চ ২০২৪ ৪,২০,০০০ N/A (উচ্চ) N/A বাংলাদেশ ব্যাংক (বিবি)
জুন ২০২৩ ২,১১,৩৯১ N/A বাংলাদেশ ব্যাংক (বিবি)

  

২.২. রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাংকের NPL প্রোফাইল

খেলাপি ঋণের এই চাপ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ওপর সবচেয়ে বেশি পড়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) মোট খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের নিচে রাখার শর্ত দিয়েছে । কিন্তু সর্বশেষ হিসাবে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের হার এখনো ২৫ শতাংশের কাছাকাছি রয়েছে । এই উচ্চ হার নির্দেশ করে যে এই ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি (Capital Shortfall) মারাত্মক এবং তা পূরণ করতে সরকারকে বারবার ভর্তুকি দিতে হয়েছে। ২০১২-১৩ অর্থবছর থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর পর্যন্ত সরকার কেবল মূলধন ঘাটতি মেটাতে ১২ হাজার ৪৭২ কোটি টাকার বেশি ভর্তুকি দিয়েছে ।   

পরিস্থিতির গভীরতা বিবেচনা করে বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে সরকারি খাতের অগ্রণী ও জনতা এবং বেসরকারি খাতের আইএফআইসি, ইউসিবি, এনআরবি ও এনআরবি কমার্শিয়ালসহ কয়েকটি ব্যাংককে একীভূত করার উদ্যোগ নিয়েছে । ব্যাংক একীভূতকরণের এই প্রক্রিয়া আর্থিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার একটি মরিয়া চেষ্টা হিসেবে দেখা হচ্ছে, তবে এটি প্রমাণ করে যে কিছু ব্যাংকের আর্থিক দুর্বলতা একক প্রচেষ্টায় পুনরুদ্ধার করার সীমা অতিক্রম করেছে।   

২.৩. ‘অদৃশ্য’ খেলাপি ঋণের বিশ্লেষণ (The Hidden NPLs)

সরকারিভাবে প্রকাশিত ৫.৩ লাখ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ শুধুমাত্র দৃশ্যমান অংশ। প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ সরকারি হিসাবের চেয়ে অনেক বেশি হতে পারে, কারণ আইনি কারচুপি এবং নীতি শিথিলতার মাধ্যমে বিপুল অঙ্কের ঋণকে তালিকা ও হিসাবের বাইরে রাখা হয়েছে।

বড় ঋণ খেলাপিরা প্রভাব খাটিয়ে বারবার ঋণ পুনর্গঠন বা পুনঃতফসিল করে নিয়মিত দেখিয়েছেন । এছাড়া আদালতের স্থগিতাদেশ নিয়েও অনেক ঋণগ্রহীতা দীর্ঘ সময় ধরে খেলাপি ঋণের তালিকা থেকে বাইরে থাকছেন । নীতিগতভাবে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের আগে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসার জন্য ঋণ পুনঃতফসিলের সুবিধা দিয়েছিল, যা ঋণ পরিশোধের শর্ত শিথিল করে । এমনকি মন্দ শ্রেণির খেলাপি ঋণ অবলোপনে (Write-off) সময়সীমা শিথিল করার ফলে প্রকৃত NPL এর চিত্র আংশিক গোপন থাকতে পারে ।   

এই ধরনের নীতি শিথিলতার মাধ্যমে খেলাপি ঋণের হার সংখ্যাগতভাবে কম দেখানো সম্ভব হলেও, এর নেতিবাচক প্রভাব ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ স্বাস্থ্যের ওপর পড়ে। এই পুনর্গঠন খেলাপি ঋণকে কৃত্রিমভাবে ‘নিয়মিত’ দেখায়, কিন্তু ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি এবং নিরাপত্তা সঞ্চিতি (Provision) চাহিদাকে কমায় না। এর ফলে ব্যাংকের নিট মুনাফা কমে যায়, যেমন জনতা ব্যাংক খেলাপি ঋণের বিপরীতে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে গিয়ে ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা লোকসান করেছে । এই আর্থিক দুর্বলতা আমানতকারীদের আস্থাকে সরাসরি দুর্বল করে, যা পরবর্তীতে তারল্য সংকটে রূপ নেয়। এটি স্পষ্ট করে যে ব্যাংকিং খাতের সংকটটি তারল্যের অভাবের চেয়েও বেশি সচ্ছলতা (Solvency) এবং সম্পদের গুণগত মানের (Asset Quality) সংকট।   

৩. মূল কারণসমূহ: সুশাসনের অভাব, রাজনীতি ও সিন্ডিকেট (The Root Causes: Governance and Kleptocracy)

৩.১. কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা খর্ব এবং দ্বৈত শাসন

বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের সংকটের মূলে রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা খর্ব হওয়া। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন উল্লেখ করেছেন যে ব্যাংকিং কমিশন গঠনের নির্দেশনা সত্ত্বেও বাংলাদেশ ব্যাংক তার স্বাধীনতা হারিয়েছে। কমিশনের সফলতা নির্ভর করে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ছাড়া কাজ করার অনুমতির ওপর ।   

সুশাসনের অভাবের মূল কারণ হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীন নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি কার্যক্রমে বাহ্যিক চ্যালেঞ্জের উপস্থিতি চিহ্নিত করা হয় । এর মধ্যে রয়েছে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ব্যবসায়ী অংশ কর্তৃক তাদের ইচ্ছে অনুসারে আইন পরিবর্তন, ব্যাংকিং খাতে ব্যবসায়ীদের অবাধ প্রবেশ ও নিয়ন্ত্রণের সুযোগ সৃষ্টি। এছাড়া আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ (এফআইডি) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ব্যাংকিং খাতের দ্বৈত নিয়ন্ত্রণ প্রবর্তন করা হয়েছে, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং বাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টি করেছে ।   

সিপিডি’র পর্যবেক্ষণ আরও কঠোর: তারা মনে করে দেশের ব্যাংক খাত ‘নষ্ট রাজনীতির শিকার’ এবং বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয় আমানতকারীদের পরিবর্তে ‘নষ্ট ও ভ্রষ্ট লোকের স্বার্থ রক্ষা করছে’ । এটি প্রমাণ করে যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন আর নিরপেক্ষ তদারককারী প্রতিষ্ঠান নয়, বরং রাজনৈতিক ইচ্ছার বাস্তবায়নকারী হিসেবে কাজ করতে বাধ্য হয়েছে।   

সারণী ২: ব্যাংকিং খাতে সুশাসনের বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জসমূহ

চ্যালেঞ্জের ধরন প্রকৃতি প্রভাব সূত্র
বাহ্যিক চ্যালেঞ্জ: রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ক্ষমতাসীন দলের ব্যবসায়ী অংশ কর্তৃক আইন পরিবর্তন, BB-এর সিদ্ধান্ত প্রভাবিত করা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা খর্ব, দ্বৈত নিয়ন্ত্রণ (এফআইডি)।
বাহ্যিক চ্যালেঞ্জ: ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর প্রভাব রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে ব্যাংকিং নীতি পরিবর্তন, ঋণ সিন্ডিকেট। নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা, তদারকি নিয়ম-নীতি উপেক্ষা।
অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ: তদারকি দুর্বলতা নেতৃত্বের সক্ষমতায় ঘাটতি, তদারকিতে স্বচ্ছতার অভাব। অনিয়ম দুর্নীতি, আইটি সিস্টেমের সুরক্ষা দুর্বলতা।

  

৩.২. ঋণ লুটপাট এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি (Culture of Impunity)

বিগত দেড় দশকে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে হলমার্ক, বিসমিল্লাহ গ্রুপ, বেসিক ব্যাংক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা চুরির মতো একাধিক বড় আর্থিক কেলেঙ্কারি ঘটেছে । এসব কেলেঙ্কারিতে ৩০ হাজার কোটি টাকারও বেশি চুরি বা আত্মসাৎ করা হয়েছে । উদ্বেগের বিষয় হলো, এত বড় আকারের লুটপাট হলেও উল্লেখযোগ্য কারো শাস্তি হয়নি, ফলে সমাজে একটি বিচারহীনতার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে । এই বিচারহীনতা ঋণ লুটপাটের চক্রকে আরও শক্তিশালী করেছে।   

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে যে বিগত সরকারের শাসনকালে ‘রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় নজিরবিহীন দুর্নীতির মাধ্যমে এক ধরনের অলিগার্কিক (oligarchic) ও চৌর্যতান্ত্রিক (kleptocratic) ক্ষমতা-কাঠামো গড়ে তোলা হয়েছিল’ । প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে যে দুদকের ইচ্ছাকৃত নিষ্ক্রিয়তা এই ক্ষমতা-কাঠামো গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। এর ফলে ব্যাংকিং খাত এখন কেবল বিনিয়োগের উৎস নয়, বরং জাতীয় সম্পদ লুণ্ঠনের একটি প্রধান চ্যানেলে পরিণত হয়েছে, যেখানে টাকা পাচার হচ্ছে এবং ভালো উদ্যোক্তারা ন্যায্য ঋণ পাচ্ছেন না ।   

৩.৩. আইনি কাঠামোয় ত্রুটি ও পরিচালকদের অযাচিত সুবিধা

ব্যাংকিং আইন ও নীতি কাঠামোর দুর্বলতা এবং তা রাজনৈতিক সুবিধার জন্য পরিবর্তন করা ব্যাংকিং খাতের সুশাসনকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে একই পরিবার থেকে চারজন পরিচালককে একটানা তিন মেয়াদে (৯ বছর) থাকার বিধান রেখে যে আইন সংশোধিত হয়েছিল , তা কর্পোরেট সুশাসনকে সম্পূর্ণভাবে ভেঙে দিয়েছে। আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ এই পরিবর্তন ব্যাংকগুলোর অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণকে পরিবারের হাতে কেন্দ্রীভূত করেছে।   

যদিও আইএমএফের শর্ত মেনে সম্প্রতি ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করা হয়েছে এবং একই পরিবার থেকে পরিচালকের সংখ্যা তিনে নামিয়ে আনা হয়েছে, কিন্তু এই আইন সংস্কার যথেষ্ট নয় । স্বতন্ত্র পরিচালকদের নিয়োগেও পক্ষপাতিত্ব দেখা যায়, যেখানে তারা মূল উদ্যোক্তাদের আত্মীয়স্বজন বা বন্ধু হওয়ায় আমানতকারীদের স্বার্থের পরিবর্তে মালিক পক্ষের স্বার্থ রক্ষা করেন । এই নীতিগত ব্যর্থতার কারণে আমানতকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী স্বতন্ত্র পরিচালকদের কার্যকারিতা প্রায় শূন্যে নেমে আসে।   

৩.৪. সামষ্টিক অর্থনৈতিক চাপ (Macroeconomic Stress)

খেলাপি ঋণের অভ্যন্তরীণ সংকটের পাশাপাশি সামষ্টিক অর্থনৈতিক চাপও ব্যাংকিং খাতকে দুর্বল করেছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে বাংলাদেশ ব্যাংক সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি দিয়েছে, যার ফলে সব ধরনের সুদের হার বেড়েছে । এর ফলস্বরূপ ‘কস্ট অব ফান্ড’ বেড়ে যাওয়ায় ভালো ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা পর্যাপ্ত ঋণ পাচ্ছেন না, যা সামগ্রিক বিনিয়োগকে সংকুচিত করেছে ।   

এছাড়াও, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর মতো গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো ইঙ্গিত দিয়েছে যে দেশের আমদানি ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে, যা অর্থনীতির অন্যান্য সূচকের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ । সিপিডি মনে করে, আমদানির নামে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে দেশের বাইরে টাকা পাচার করা হচ্ছে। এই পুঁজি পাচার ব্যাংকিং খাতে ডলারের সংকট তৈরি করেছে এবং দেশের তারল্য পরিস্থিতিকে আরও নাজুক করে তুলেছে।   

৪. গভীর বিশ্লেষণ: জনতা ব্যাংক কেলেঙ্কারি, জে এইচ সুমন ও আস্থার সংকট (The Janata Bank Case Study)

৪.১. জনতা ব্যাংকের ভঙ্গুর দশা: ঋণ লুটপাটের প্রতিচ্ছবি

রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক লিমিটেডের বর্তমান দৈন্যদশা বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টরের গভীর কাঠামোগত দুর্বলতা এবং রাজনৈতিক প্রভাবে ঋণ লুটপাটের এক প্রতিচ্ছবি। ব্যাংকটি আওয়ামী লীগ–ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী গোষ্ঠীগুলোকে অনিয়মের মাধ্যমে বিশাল অঙ্কের ঋণ দিয়েছে, যার পরিণতিতে এটি আজ দেশের অন্যতম সংকটাপন্ন ব্যাংক।

এই সংকটের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে এননটেক্স গ্রুপ এবং ক্রিসেন্ট গ্রুপের বিশাল অঙ্কের ঋণ কেলেঙ্কারি। এননটেক্স গ্রুপের ২২টি প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্যাংকটির ঋণ দাঁড়িয়েছে সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক এর মধ্যে ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা খেলাপি করার নির্দেশ দিয়েছে । অপরদিকে, ক্রিসেন্ট গ্রুপের পাঁচ প্রতিষ্ঠানের কাছে জনতা ব্যাংকের পাওনা ২ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা, যার প্রায় পুরোটাই কেন্দ্রীয় ব্যাংক খেলাপি করে দিয়েছে । এই ঘটনাটি দেশের ব্যাংক খাতের একক ঋণের বৃহত্তম কেলেঙ্কারি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। এই বিশাল খেলাপি ঋণের বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি (Provision) রাখতে গিয়েই জনতা ব্যাংক কেবল জানুয়ারি-জুন সময়ে ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা লোকসান করেছে ।   

৪.২. রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার যোগসূত্র

জনতা ব্যাংকের ঋণ বিতরণে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার বিষয়টি একাধিক সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে। ব্যাংকটিতে আওয়ামী লীগ–ঘনিষ্ঠ গ্লোব জনকণ্ঠ শিল্প পরিবারের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৮০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২২৫ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছিল তৎকালীন একজন প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার বিশেষ সুপারিশে । এই তথ্যগুলি প্রমাণ করে যে ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক মানদণ্ডকে উপেক্ষা করে রাজনৈতিক প্রভাবকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে, যার অনিবার্য পরিণতি আজকের এই সংকট।   

৪.৩. জনতা নিউজ ও প্রতিবেদক জে এইচ সুমন: অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ভূমিকা

দেশের ব্যাংকিং খাতের এই ভয়াবহ অনিয়ম এবং রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে সংঘটিত ঋণ লুটপাটের বিষয়টি জনসমক্ষে আনতে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। জনতা নিউজ ম্যাগাজিন এবং প্রতিবেদক জে এইচ সুমন-এর মতো সাংবাদিকরা এই আর্থিক অনিয়মের নেপথ্যের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার দিকটি তুলে ধরেছেন। এই অনুসন্ধানের ফলেই আমানতকারীরা ব্যাংকিং খাতের ভঙ্গুরতা সম্পর্কে অবগত হয়েছেন এবং এর ফলে জনগণের আস্থাহীনতা আরও বেড়েছে।

৪.৪. আস্থার সংকট এবং তারল্য ব্যবস্থাপনা

রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত ঋণ বিতরণের ফলে জনতা ব্যাংকের তারল্য ব্যবস্থাপনা চরম সংকটে পড়েছে। আমানতকারীরা যখন দেখেন যে তাদের টাকা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত গোষ্ঠীর কাছে চলে যাচ্ছে এবং তা আর ফেরত আসছে না, তখন তারা আমানত তুলে নিতে শুরু করে । ফলস্বরূপ, জনতা ব্যাংকের আমানত জুলাই ও আগস্ট মাসে ২ হাজার ৬১২ কোটি টাকা কমে যায় ।   

এই আমানত হ্রাস পাওয়ায় ব্যাংকটিতে তারল্যসংকট দেখা দিয়েছে। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে ব্যাংকটিকে এখন দৈনিক ১৮ থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা ধার করে নিয়মিত কার্যক্রম চালাতে হচ্ছে । এটি প্রমাণ করে যে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে সৃষ্ট সচ্ছলতা (Solvency) সমস্যাটি শেষ পর্যন্ত বাজারের আস্থার অভাবে একটি তীব্র তারল্য সংকটে রূপান্তরিত হয়েছে। জনতা ব্যাংকের এই পরিস্থিতিই সামগ্রিক ব্যাংক খাতের পদ্ধতিগত ঝুঁকিকে তুলে ধরে, যেখানে খেলাপি ঋণ আদায়ে রাষ্ট্রের সহায়তা ছাড়া ব্যাংকটির পক্ষে স্বাভাবিক ব্যবসায় ফেরা প্রায় অসম্ভব বলে ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিজেই স্বীকার করেছেন ।   

৫. উত্তরণের বাস্তবসম্মত পথনকশা: প্রাতিষ্ঠানিক ও আইনি সংস্কার (Roadmap for Realistic Reform)

বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টরের এই গভীর সংকট থেকে উত্তরণের জন্য গতানুগতিক পদক্ষেপ যথেষ্ট নয়; বরং আমূল প্রাতিষ্ঠানিক ও আইনি সংস্কার প্রয়োজন। এই সংস্কারের সফলতা নির্ভর করছে রাজনৈতিক নেতৃত্বের দৃঢ় অঙ্গীকারের ওপর, কারণ ব্যাংক খাতের ‘বিষফোঁড়া’ খেলাপি ঋণ দূর করতে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া তা অসম্ভব ।   

৫.১. রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও আমূল সংস্কারের অঙ্গীকার

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)-এর নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হানসহ অন্যান্য বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন, সংস্কারের সফলতা নির্ভর করবে বাস্তবায়নের ওপর, যা বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং নতুন সরকারের কাঁধে বর্তায় । এই সংস্কারের পূর্বশর্ত হলো রাষ্ট্রের সব স্তরে সুশাসন প্রতিষ্ঠা।   

এক্ষেত্রে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)-এর ব্যাপক আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের কোনো বিকল্প নেই। কারণ অতীতে দুদকের ইচ্ছাকৃত নিষ্ক্রিয়তা অলিগার্কিক ও চৌর্যতান্ত্রিক ক্ষমতা-কাঠামো গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে । দুর্নীতি দমনে শুধুমাত্র দুদক নয়, রাষ্ট্রীয় ও অরাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকেও কার্যকরভাবে সম্পৃক্ত করার জন্য প্রয়োজনীয় নীতি ও আইনি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে ।   

৫.২. কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও তদারকি জোরদার

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করা সংস্কারের মূল চাবিকাঠি। দেশের অর্থনীতির স্বার্থে বাংলাদেশ ব্যাংককে সরকারের সরাসরি নিয়ন্ত্রণের বাইরে রাখা এবং তার স্বাধীনতা নিশ্চিত করা জরুরি । কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষমতাকে সীমিত করে দেওয়া আইন ও নীতি কাঠামো সংস্কার করতে হবে, যাতে রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক হস্তক্ষেপের সুযোগ বন্ধ হয় ।   

এছাড়াও, বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব তদারকি সক্ষমতা বৃদ্ধি করা আবশ্যক। অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ, যেমন—নেতৃত্বের সক্ষমতায় ঘাটতি এবং তদারকি কাজে সংঘটিত অনিয়ম দুর্নীতি কঠোরভাবে দমন করতে হবে । ব্যাংকিং খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বাড়াতে আন্তর্জাতিক আর্থিক রিপোর্টিং মান বা আইএফআরএস (IFRS) অনুযায়ী একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করা এবং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা উন্নত করার জন্য পর্যাপ্ত তথ্য সরবরাহ করা উচিত ।   

৫.৩. খেলাপি ঋণ ব্যবস্থাপনার বিশেষ কৌশল (AMC এবং লিগ্যাল অ্যাকশন)

বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য বিশেষায়িত কৌশলের প্রয়োজন। মার্কেন্টাইল ব্যাংক পিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মতিউল হাসানসহ বিশেষজ্ঞরা খেলাপি ঋণ আদায়ে সরকারি-বেসরকারি খাতের যৌথ উদ্যোগে অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি (AMC) প্রতিষ্ঠা করার প্রস্তাব দিয়েছেন । AMC ব্যাংকগুলোর চাপ কমাবে এবং এই বিষাক্ত সম্পদ (Toxic Assets) শোষণ করে দ্রুত পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করবে। বাংলাদেশ ব্যাংক আগামী দুই বছরের মধ্যে খেলাপি ঋণ ৪৩,৩০০ কোটি টাকা কমানোর যে রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে, তার বাস্তবায়ন এই ধরনের বিশেষায়িত কোম্পানির মাধ্যমে সম্ভব হতে পারে ।   

পাশাপাশি, ব্যাংকগুলোর ওপর চাপ কমাতে কার্যকর ঋণ পুনর্বিক্রয় বাজার (Effective Loan Resale Market) প্রতিষ্ঠা করা জরুরি, যা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য বিকল্প অর্থায়নের সুযোগ তৈরি করবে ।   

৫.৪. আইনি জবাবদিহিতা ও সম্পদ পুনরুদ্ধার

খেলাপি ঋণের মূল হোতাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেওয়া অপরিহার্য। সম্প্রতি প্রস্তাবিত ব্যাংকিং আইন (যেমন BRO 2025)-এর ধারা ৭৭ ও ৭৮ অনুযায়ী, যারা প্রতারণামূলকভাবে ব্যাংকের সম্পদ বা তহবিলের অপব্যবহার করেছে, তাদের ‘দায়ী ব্যক্তি’ (Responsible Persons) হিসেবে চিহ্নিত করে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে । দায়ী ব্যক্তির সংজ্ঞায় নিয়ন্ত্রণকারী শেয়ারধারক, পরিচালক, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এবং অসৎভাবে সম্পদ আত্মসাৎকারী ব্যক্তিরা অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন ।   

আইনের কার্যকর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হলে, চুক্তির শর্ত পূরণ না হলে ঋণগ্রহীতাকে সমস্ত বকেয়া ঋণ পরিশোধে বাধ্য করার বিধান ‘ত্বরান্বিতকরণ অধিকার’ (Acceleration Rights)-এর কঠোর বাস্তবায়ন দরকার । এছাড়া, সংকটাপন্ন ব্যাংকগুলোর দ্রুত অবসায়ন (Resolution) বা একীভূতকরণ প্রক্রিয়ায় স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার জন্য ব্যাংকিং সেক্টর ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট কাউন্সিল (BCMC) দ্রুত গঠন করা উচিত ।   

সারণী ৩: সংকট উত্তরণে আইএমএফ এবং বিশেষজ্ঞ প্রস্তাবিত প্রধান সংস্কারসমূহ

ক্ষেত্র প্রস্তাবিত পদক্ষেপ লক্ষ্য সূত্র
ঋণ ব্যবস্থাপনা অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি (AMC) প্রতিষ্ঠা ও রোডম্যাপ বাস্তবায়ন। NPL কার্যকরভাবে পুনরুদ্ধার ও ব্যাংকগুলোর চাপ কমানো।
প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ (রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত)। দ্বৈত শাসন বাতিল, নিরপেক্ষ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা।
আইনি জবাবদিহিতা ব্যাংকের সম্পদ অপব্যবহারের জন্য দায়ী ব্যক্তির (ধারা ৭৮, BRO 2025) বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ। ব্যাংক তহবিল অপব্যবহার রোধে আইনি কঠোরতা নিশ্চিত করা।
ঝুঁকি মানদণ্ড IFRS অনুযায়ী আন্তর্জাতিক আর্থিক রিপোর্টিং মান নিশ্চিত করা। ব্যাংকিং খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বৃদ্ধি।

  

৫.৫. ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ও নৈতিকতার মানদণ্ড

একটি স্থিতিশীল ব্যাংকিং ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য অভ্যন্তরীণ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা নীতি (Risk Management Policy) ও পদ্ধতি প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন করা জরুরি। পরিচালনা পর্ষদকে অবশ্যই অযৌক্তিক এবং অপ্রত্যাশিত ঝুঁকি এড়াতে একটি নির্দিষ্ট সীমা রেখা পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে । ঝুঁকি পরিমাপ এবং মূল্যায়নের সঠিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি (যেমন আংকিক মূল্যায়ন পদ্ধতি) প্রয়োগের মাধ্যমে অযাচিত ঝুঁকি গ্রহণ এড়ানো সম্ভব ।   

পাশাপাশি, গ্রাহক স্বার্থ সংরক্ষণ এবং আর্থিক স্থিতিশীলতা অর্জন ও ধরে রাখার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক নৈতিকতার মানদণ্ড এবং গ্রাহক সেবার তালিকা তৈরি করে তা অনুসরণ করা উচিত । উন্নত ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এবং নৈতিকতার মানদণ্ড বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে পারলে ব্যাংকিং খাত অভ্যন্তরীণভাবে শক্তিশালী হতে পারবে।   

৬. উপসংহার: ভবিষ্যৎ স্থিতিশীলতার জন্য জরুরি পদক্ষেপ ও প্রত্যাশা

বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টরের অস্থিরতা এখন একটি চরম সীমানায় পৌঁছেছে, যার প্রতিফলন দেখা যায় ৫ লাখ কোটি টাকার বেশি খেলাপি ঋণের মধ্যে। এই সংখ্যাটি একটি বৃহৎ চৌর্যতান্ত্রিক কাঠামোর দ্বারা রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠনের কেবল দৃশ্যমান অংশ মাত্র। জনতা ব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর করুণ পরিণতি দেখায় যে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ঋণ বিতরণ কীভাবে একটি শক্তিশালী ব্যাংককে তারল্য সংকটের মুখে ফেলে দেয়।

পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয় যে, আইএমএফ বা বিশ্বব্যাংকের শর্ত মেনে কাগজে-কলমে আইন সংস্কার করা হলেও, যদি রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকে তবে সেই আইনগুলো কেবল ‘কাগজে-কলমের সংস্কার’ হিসেবেই থেকে যাবে। এই সংকট উত্তরণের পথনকশা দুটি মূল স্তম্ভের ওপর নির্ভর করে:

১. প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা: কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং দুর্নীতি দমন কমিশনকে রাজনৈতিক ও ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর প্রভাবমুক্ত করে তাদের পূর্ণ তদারকি ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করতে হবে। দ্বৈত নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বাতিল করে বাংলাদেশ ব্যাংকের একক কর্তৃত্ব নিশ্চিত করা আবশ্যক। ২. জিরো টলারেন্স নীতি: ঋণ লুটপাট এবং ব্যাংকের তহবিল অপব্যবহারের জন্য দায়ী ব্যক্তি, সে যেই হোক না কেন—পরিচালক, নিয়ন্ত্রক শেয়ারহোল্ডার বা শীর্ষ নির্বাহী—তাদের বিরুদ্ধে সদ্য সংস্কারকৃত আইনি কাঠামো (যেমন BRO 2025) ব্যবহার করে কঠোর ও দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দ্রুত বিষাক্ত সম্পদ পুনরুদ্ধার কার্যক্রম শুরু করতে হবে।

বাংলাদেশের অর্থনীতির স্থিতিশীলতা, বিনিয়োগের পরিবেশ এবং জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য এই ‘৫ লাখ কোটি টাকার বিষফোঁড়া’ উপড়ে ফেলার বিকল্প নেই। এই লক্ষ্য অর্জনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং পরবর্তী রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে দৃঢ় অঙ্গীকার এবং সময়াবদ্ধ কর্মপরিকল্পনার দাবি রাখে দেশের আপামর জনগণ।

One thought on “বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের সংকট: কারণ, প্রভাব ও সমাধান বিশ্লেষণ

  1. খেলাপি ঋণের লাগামহীন উল্লম্ফন, সুশাসনের চূড়ান্ত পতন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুর্বল তদারকি এবং আমানতকারীদের আস্থাহীনতা সম্মিলিতভাবে দেশের আর্থিক ভিত্তিকে হুমকির মুখে ফেলেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *