শিয়া ইসলাম: ইতিহাস, ধর্মতত্ত্ব, ভূ-রাজনীতি এবং বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সাম্প্রদায়িক সংঘাতের বিশ্লেষণ
প্রতিবেদক: জে এইচ সুমন (জনতা নিউজ ম্যাগাজিন)
প্রথম অধ্যায়: শিয়া ইসলামের মূল ভিত্তি ও ঐতিহাসিক বিভাজন
১.১. ভূমিকা: বিশ্ব মুসলমান সমাজে শিয়াদের জনমিতি ও অবস্থান
শিয়া ইসলাম (الشيعة, al-Shīʿa বা التشيع al-Tashayyuʿ) ইসলাম ধর্মের দ্বিতীয় বৃহত্তম শাখা। আরবিতে শিয়া শব্দের অর্থ ‘দল’ বা ‘গোষ্ঠী’, যা মূলত ‘শি’আতু আলী’ (আলীর দল) থেকে এসেছে । বিশ্বব্যাপী প্রায় দুই বিলিয়ন মুসলিমের মধ্যে শিয়া মুসলমানের সংখ্যা আনুমানিক ১০% থেকে ২০% । সুন্নিরা অধিকাংশ মুসলিম দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও, শিয়ারা ইরান, ইরাক এবং আজারবাইজানের মতো গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলিতে নাগরিক জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ গঠন করে । এছাড়াও, লেবানন, পাকিস্তান এবং ইয়েমেনের মতো দেশগুলিতেও তাদের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি রয়েছে। বাংলাদেশের ১৬ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে শিয়া সম্প্রদায়ের মানুষ আনুমানিক ২২ লাখের মতো, যা মোট মুসলিম জনসংখ্যার একটি ক্ষুদ্র অংশ । শিয়াদের ইতিহাস, ধর্মতত্ত্ব এবং বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক কার্যকলাপ মুসলিম উম্মাহর অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক গভীর ও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে আসছে।
১.২. ইসলামের প্রথম গৃহযুদ্ধ: খিলাফত বনাম ইমামতের বিতর্ক
শিয়া-সুন্নি বিভাজনের মূল কারণ হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মৃত্যুর পর তাঁর স্থলাভিষিক্ত বা নেতা নির্বাচনের পদ্ধতি ঘিরে আবর্তিত। এই মতবিরোধই ইসলামের ইতিহাসে প্রথম বৃহৎ বিবাদের জন্ম দেয় ।
সুন্নি দৃষ্টিকোণ থেকে, নবী (সা.) নেতৃত্ব নির্বাচনের বিষয়টি উম্মাহর ওপর ছেড়ে দিয়েছিলেন। সাহাবাগণ একটি নির্বাচন পদ্ধতির মাধ্যমে প্রথম খলিফা (আবু বকর), দ্বিতীয় খলিফা (উমর) এবং তৃতীয় খলিফা (উসমান)-কে নির্বাচন করেন। এই নেতারা ছিলেন মুসলিম উম্মাহর রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতা, অর্থাৎ খলিফা ।
অন্যদিকে, শিয়া মুসলমানরা মনে করেন যে নবী (সা.)-এর স্থলাভিষিক্ত নিয়োগের বিষয়টি আল্লাহ্ নিজেই নির্ধারণ করেন এবং তা রাসূল (সা.)-কে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল । শিয়াদের বিশ্বাস, নবী (সা.) গাদির খুমের দিনে তাঁর চাচাতো ভাই ও জামাতা ইমাম আলী (আ.)-কে তাঁর পরবর্তী নেতা হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন । তাঁদের মতে, আলী (আ.) এবং তাঁর বংশধরগণই ছিলেন মুসলমানদের প্রকৃত খলিফা বা ইমাম। এই নেতৃত্ব ব্যবস্থা কেবল রাজনৈতিক নয়, বরং ঐশ্বরিক ক্ষমতাপ্রাপ্ত এবং আধ্যাত্মিক দিক থেকেও নিষ্পাপ (মা’সুম)।
এই বিভাজনের গভীরে নিহিত রয়েছে নেতৃত্বের প্রকৃতি নিয়ে মৌলিক ভিন্নতা। এটি শুধু একটি রাজনৈতিক বিরোধ নয়; এই বিরোধ রাজনৈতিক স্তর পেরিয়ে ধর্মতাত্ত্বিক আকীদায় স্থান নিয়েছে । সুন্নিরা যেখানে খলিফাকে একজন মানবীয় নেতা হিসেবে দেখে, যিনি ভুল করতে পারেন, সেখানে শিয়ারা ইমামদেরকে আল্লাহ্ কর্তৃক নিযুক্ত, নির্দোষ এবং মহামানব হিসেবে বিশ্বাস করে । এই মৌলিক বিশ্বাসগত পার্থক্য ধর্মীয় আইনশাস্ত্র (ফিকহ), ধর্মীয় অনুশীলনের পদ্ধতি এবং আইনগত ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে বিশাল প্রভাব ফেলে, যা উভয় সম্প্রদায়কে দীর্ঘকাল ধরে ভিন্ন পথে পরিচালিত করেছে। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে, নবী (সা.)-এর মৃত্যুর অব্যবহিত পরে এই দ্বন্দ্ব মক্কার কুরাইশ বংশের হাশেমি (নবীজির নিজ গোত্র) এবং উমাইয়া গোত্রের মধ্যে ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফল হিসেবেও দেখা যায় । উমাইয়ারা প্রথমদিকে ইসলামের ঘোর বিরোধী ছিল এবং তারা কোনোভাবেই হাশেমিদের (আলীর গোত্র) নেতৃত্বে দেখতে চায়নি ।
১.৩. কারবালার মহাবিপর্যয়: ইমাম হোসাইন (রা.)-এর শাহাদাত
শিয়া এবং সুন্নিদের মধ্যে ঐতিহাসিক ও আত্মিক বিভেদকে চিরস্থায়ী রূপ দিয়েছে ৬১ হিজরির ১০ মহররম কারবালা প্রান্তরে সংঘটিত মর্মান্তিক ঘটনা। এই দিনে নবী (সা.)-এর দৌহিত্র হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) তাঁর পরিবার ও ক্ষুদ্র দলের সদস্যদের নিয়ে ইয়াজিদের বিশাল বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে শাহাদাত বরণ করেন ।
কারবালার এই ট্র্যাজেডি শিয়া ইসলামের পরিচয়ের একটি অপরিহার্য ভিত্তি। এটি তাঁদের কাছে শোক, ত্যাগ এবং নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রতীক। যদিও যুদ্ধের ময়দানে হোসাইন (রা.)-এর দল পরাজিত হয়েছিল, শিয়ারা বিশ্বাস করেন যে তিনি নৈতিক ও আত্মিকভাবে বিজয়ের মর্যাদায় ভূষিত হয়েছেন । এই শাহাদাত শিয়াদের ধর্মীয় আত্মপরিচয়কে স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠান-বিরোধী (Anti-Establishment) রূপে প্রতিষ্ঠিত করে। নিপীড়নমূলক শাসকের বিরুদ্ধে সর্বদাই ন্যায় ও নীতির পক্ষে দাঁড়ানোর জন্য এই ঘটনা শিয়াদের মধ্যে ঐতিহাসিক প্রেরণা যোগায়, যা আধুনিক ভূ-রাজনৈতিক সক্রিয়তা এবং ইরানের বিপ্লবী আদর্শে স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়।
যদিও সুন্নি মুসলমানদের কাছে আশুরা বা ১০ মহররম অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনার (যেমন: হজরত আদম (আ.), হজরত নুহ (আ.), হজরত মুসা (আ.)-এর মুক্তি) জন্য তাৎপর্যপূর্ণ , তবুও কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনাটি মুসলিম উম্মাহর স্মৃতির পাতায় অন্যান্য ঘটনাকে ছাপিয়ে গেছে ।
দ্বিতীয় অধ্যায়: শিয়া ধর্মতত্ত্ব, আকিদা ও বিতর্কিত অনুশীলন
২.১. ইমামত, হাদিস এবং ধর্মীয় আইনশাস্ত্রের পার্থক্য
শিয়া ধর্মতত্ত্বের মূল ভিত্তি হলো ইমামত। শিয়ারা বিশ্বাস করেন যে ইমামরা হলেন আল্লাহ্ কর্তৃক মনোনীত, নিষ্পাপ (ইসমত) এবং আধ্যাত্মিক ও রাজনৈতিক উভয় ক্ষেত্রেই অপরিহার্য নেতা। তারা কেবল হযরত আলী (আ.)-এর বংশধরদের মধ্য থেকেই আসেন । বর্তমানে বিশ্বে শিয়াদের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী শাখা হলো দ্বাদশবাদী বা ইমামিয়া শিয়া (Twelver Shia), যারা ১২ জন ইমামে বিশ্বাসী। অন্যান্য প্রধান শাখাগুলির মধ্যে রয়েছে ইসমাইলি এবং জায়দি শিয়া (যা ইয়েমেনে প্রচলিত) ।
ধর্মীয় আইনের ক্ষেত্রেও শিয়া ও সুন্নিদের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। সুন্নিরা যেখানে প্রধানত সহিহ সিত্তা (ছয়টি বিশুদ্ধ হাদিস সংকলন) অনুসরণ করে, শিয়ারা সেখানে তাদের নিজস্ব চারটি মৌলিক হাদিস গ্রন্থকে অনুসরণ করে, যার মধ্যে রয়েছে কিতাব আল-কাফী । তবে, আমিরুল মু’মিনিন আলী (আ.)-এর ভাষণ ও বক্তৃতামালার সংকলন নাহজুল বালাগ্বা শিয়াদের জন্য আল্লাহ্ ও নবী (সা.)-এর বাণীর পরই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ । মজার বিষয় হলো, এই নাহজুল বালাগ্বা সুন্নি মুসলমানের কাছেও একটি নির্ভরযোগ্য প্রামাণ্য বই হিসেবে গণ্য হয় ।
২.২. শিয়াদের বিতর্কিত আকিদা ও সুন্নিদের সমালোচনা
ঐতিহাসিক ও ধর্মতাত্ত্বিক বিভাজনের কারণে শিয়াদের কিছু বিশ্বাস ও অনুশীলন সুন্নি সম্প্রদায়ের সমালোচনার শিকার হয়েছে। সুন্নি পণ্ডিতদের মতে, শিয়া ও সুন্নিদের মধ্যকার বিরোধটি কেবল ফিকহী বা শাখা-প্রশাখার সামান্য বিরোধ নয়; বরং এটি মৌলিক ও প্রধান আকিদাসমূহের মধ্যে বিদ্যমান। তাঁদের মতে, এই বিরোধ এত গভীর যে এর অনুসারী ব্যক্তি মুসলিম মিল্লাত থেকে খারিজ হয়ে যেতে পারে ।
ক. তাকিয়া ও মুত’আ: শিয়া ধর্মতত্ত্বের দুটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো ‘তাকিয়া’ এবং ‘মুত’আ’। তাকিয়া (Taqiyya) হলো নিজেদের ধর্মীয় বিশ্বাস গোপন রাখার নীতি, যা চরম বিপদ বা নিপীড়নের সময় আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয় । যদিও এটি আত্মরক্ষার একটি ঐতিহাসিক নীতি, সুন্নি উগ্রপন্থী গোষ্ঠীগুলো এই ধারণাকে ব্যবহার করে শিয়াদেরকে ‘মিথ্যাবাদী’ এবং ‘অবিশ্বাসী’ হিসেবে চিহ্নিত করার জন্য। এর ফলে আন্তঃসাম্প্রদায়িক বিশ্বাসে ব্যাপক ঘাটতি তৈরি হয় ।
অন্যদিকে, মুত’আ (Mut’ah) হলো সাময়িক বা অস্থায়ী বিবাহ, যা শিয়াদের মধ্যে বৈধ । এটি একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অর্থের বিনিময়ে করা চুক্তি, যা সময়সীমা অতিক্রমের সাথে সাথে বাতিল হয়ে যায়, তালাকের প্রয়োজন হয় না । শিয়া সূত্রমতে, মুত’আ বিবাহকারী বিপুল পুণ্যের অধিকারী এবং এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত এক উপহার । এর বিপরীতে, সুন্নি ইসলামের বৃহৎ অংশ এটিকে হারাম বা নিষিদ্ধ মনে করে, কারণ তাদের বিশ্বাস যে হযরত উমর (রা.) এটি নিষিদ্ধ করেছিলেন। কিছু সুন্নি পণ্ডিত মুত’আকে পতিতাবৃত্তির সাথেও তুলনা করেন । শিয়া আলেম আল-কাশানী মুত’আ বিবাহকে ইমাম হোসাইন (রা.) এবং হাসান (রা.)-এর মর্যাদার সাথে তুলনা করে এর উচ্চ ধর্মীয় মূল্য প্রদান করেছেন । যখন একটি অনুশীলনকে, যা সুন্নিরা নৈতিকভাবে অগ্রহণযোগ্য মনে করে, শিয়ারা ধর্মীয়ভাবে এত উচ্চ স্থান দেয়, তখন দুই পক্ষের মধ্যে নৈতিকতা এবং ধর্মীয় বৈধতার ধারণায় বিশাল দূরত্ব তৈরি হয়, যা বিচ্ছিন্নতাকে বাড়িয়ে তোলে।
খ. অন্যান্য বিতর্ক: শিয়াদের বিরুদ্ধে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সাহাবিদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণের অভিযোগও রয়েছে । তবে শিয়াদের সম্পর্কে যে মারাত্মক মিথ্যা অভিযোগটি ইসলামের শত্রুরা প্রচার করে, তা হলো তারা নাকি বিশ্বনবী মুহাম্মাদ (সা.)-কে শেষ নবী হিসেবে স্বীকার করেন না । শিয়া মুসলমানরাও সুন্নিদের মতোই দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে নবী (সা.) শেষ নবী এবং তাঁর পরে আর কোনো নবী আসবেন না। তারা সর্বদা তাঁর নাম শোনার সঙ্গে সঙ্গে দরুদ পাঠ করে সম্মান প্রদর্শন করেন ।
শিয়া ও সুন্নি মতবাদের প্রধান পার্থক্যগুলি নিম্নলিখিত সারণিতে সংক্ষেপে দেখানো হলো:
Table 1: শিয়া ও সুন্নি মতবাদের প্রধান পার্থক্য (ঐতিহাসিক ও আকিদাগত)
| আলোচ্য বিষয় | শিয়া দৃষ্টিভঙ্গি (মূলত দ্বাদশী) | সুন্নি দৃষ্টিভঙ্গি (আহলে সুন্নাত) | প্রাসঙ্গিকতা |
| নেতৃত্ব (খিলাফত/ইমামত) | ইমামত (ঐশ্বরিক নিয়োগ, আহলে বাইত থেকে নিষ্পাপ নেতা)। | খিলাফত (মুসলিম উম্মাহর দ্বারা নির্বাচন বা মনোনয়ন)। | বিভাজনের মূল ঐতিহাসিক কারণ। |
| সর্বোচ্চ ধর্মীয় উৎস | কুরআন, সুন্নাহ (আহলে বাইতের মাধ্যমে), নাহজ আল-বালাগ্বা। | কুরআন, সুন্নাহ (সহিহ সিত্তা ও অন্যান্য নির্ভরযোগ্য হাদিস)। | ধর্মীয় আইনের ভিন্নতা। |
| অস্থায়ী বিবাহ | মুত’আ (অস্থায়ী বিবাহ) হালাল এবং পুণ্যময়। | মুত’আ (অস্থায়ী বিবাহ) হারাম বা নিষিদ্ধ। | মৌলিক ফিকহী ও নৈতিক বিরোধের উদাহরণ। |
| আত্মগোপন নীতি | তাকিয়া (বিপদের সময় বিশ্বাস গোপন রাখা) বৈধ। | সাধারণত কঠোরভাবে নিষিদ্ধ (জরুরি অবস্থা ছাড়া)। | আন্তঃসাম্প্রদায়িক আস্থার অভাবের উৎস। |
| আশুরার গুরুত্ব | ইমাম হোসাইন (রা.)-এর শাহাদাতের শোক ও ত্যাগ। | অন্যান্য নবীদের ঐতিহাসিক ঘটনা এবং নফল রোজা। | ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মৌলিক পার্থক্য। |
তৃতীয় অধ্যায়: বৈশ্বিক শিয়া কার্যক্রম ও আধুনিক ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
৩.১. ইরান: শিয়া ভূ-রাজনীতির কেন্দ্র ও আদর্শিক অবস্থান
১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পর থেকে ইরান বৈশ্বিক শিয়া ভূ-রাজনীতির কেন্দ্রীয় শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। দ্বাদশবাদী শিয়া মতবাদকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে ইরান মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষমতার ভারসাম্যে পরিবর্তন এনেছে ।
ইরানের পক্ষ থেকে শিয়া-সুন্নি ঐক্যের বার্তা প্রায়শই প্রচার করা হয়। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি বারবার জোর দিয়ে বলেছেন যে, শিয়া ও সুন্নিরা একই ইসলামি উম্মাহর অংশ এবং তাদের মধ্যে বিভাজনের চেষ্টা শত্রুদের ষড়যন্ত্র । এই আদর্শিক অবস্থান সত্ত্বেও, ইরানের বৈদেশিক নীতি কেবল শিয়া সম্প্রদায়ের স্বার্থে সীমাবদ্ধ নয়; বরং মজহাব নির্বিশেষে মুসলিম নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা পালন করে। একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হলো, ইরান দীর্ঘকাল ধরে ফিলিস্তিনের সুন্নি প্রতিরোধ সংগঠন হামাস এবং ইসলামিক জিহাদকে আর্থিক ও সামরিক সহায়তা দিয়ে আসছে । ১৯৯০-এর দশকে বসনিয়ার মুসলিমদের ওপর সার্ব বাহিনীর গণহত্যার সময়ও ইরান পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে তাদের অস্ত্র, প্রশিক্ষণ ও কূটনৈতিক সহায়তা দিয়েছিল ।
ইরানের এই দ্বৈত নীতি, অর্থাৎ একইসঙ্গে শিয়া প্রক্সিদের সমর্থন করা এবং সুন্নি প্রতিরোধ সংগঠনকে সহায়তা করা, দেখায় যে তাদের নীতি ধর্মীয় বিভেদ নিরসনের চেয়ে পশ্চিমা বা ইসরায়েলি প্রভাব হ্রাস করা এবং আঞ্চলিক শক্তিসাম্য পরিবর্তন করার কৌশল দ্বারা বেশি পরিচালিত হয়।
৩.২. আঞ্চলিক প্রক্সি নেটওয়ার্ক এবং প্রভাব বিস্তার
আধুনিক মধ্যপ্রাচ্যে শিয়া-সুন্নি সংঘাত প্রধানত ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে আঞ্চলিক আধিপত্য বিস্তারের প্রক্সি যুদ্ধের মাধ্যমে তীব্রতা লাভ করেছে । ইরানের ইসলামিক রেভ্যুলেশনারি গার্ড (IRGC) এই কৌশলগত তৎপরতার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে, যার উদ্দেশ্য মধ্যপ্রাচ্যে শিয়াদের অবস্থান শক্তিশালী করা এবং সুন্নি ও ইসরায়েলের প্রভাব হ্রাস করা ।
ক. হিজবুল্লাহ: লেবাননের এই শিয়া মুসলিম জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী ইরানের প্রধান প্রক্সি। হিজবুল্লাহর সামরিক বাজেট ও অস্ত্রের প্রায় ৭০ ভাগ আসে ইরান থেকে । সিরিয়া যুদ্ধে তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ সামরিক ও রাজনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধি করেছে, কিন্তু একই সাথে লেবানন ও বৃহত্তর অঞ্চলে শিয়া-সুন্নি উত্তেজনা বাড়িয়েছে ।
খ. ইরাক ও ইয়েমেন: ২০০৩ সালে সাদ্দাম হোসেনের উৎখাতের পর ইরাকে শিয়ারা ক্ষমতার মূল নিয়ন্ত্রণ দখল করে, যা ইরানকে তার প্রভাব বিস্তারের সুযোগ দেয় । ইয়েমেনে জায়দি শিয়াদের হুথি বিদ্রোহীরা ইরান কর্তৃক সমর্থিত, যা ইয়েমেনকে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের সাথে সরাসরি সংঘর্ষের প্রধান ময়দান বানিয়েছে ।
গ. শিয়াদের সক্ষমতা: ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, শিয়ারা সংখ্যায় কম হওয়া সত্ত্বেও মধ্যপ্রাচ্যে সুন্নিদের থেকে অধিক সুসংগঠিত এবং কার্যকরভাবে ক্ষমতা বিস্তার করতে সক্ষম। এর প্রধান কারণ, ইরান তাদের শক্তিশালী কেন্দ্রীয় পৃষ্ঠপোষক হিসেবে কাজ করে এবং সামরিক প্রযুক্তি (যেমন: ড্রোন তৈরিতে আন্তর্জাতিক সহায়তা) সহ কৌশলগত সমর্থন সরবরাহ করে । এই সুসংগঠিত সামরিক শক্তি আঞ্চলিক শক্তিসাম্যে পরিবর্তন এনেছে, যা সুন্নি-আরব আধিপত্যের অবসান ঘটিয়ে নতুন মেরুকরণ তৈরি করছে ।
৩.৩. সুন্নি উগ্রবাদ কর্তৃক শিয়া নিপীড়ন
ভূ-রাজনৈতিক উত্থানের পাশাপাশি শিয়ারা বিশ্বব্যাপী সুন্নি উগ্রবাদী গোষ্ঠীর দ্বারা তীব্র নিপীড়নের শিকার। ইসলামিক স্টেট অফ ইরাক অ্যান্ড সিরিয়া (ISIS) বা দাঈশ একটি সুন্নি আরব সংগঠন হিসেবে সিরিয়ায় শিয়া আসাদ সরকার এবং ইরাকের শিয়াদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। এই গোষ্ঠীটি শিয়াদের ওপর ব্যাপক নিপীড়ন চালিয়েছে এবং প্রায়শই শিয়া মসজিদ ও ধর্মীয় স্থাপনায় হামলা করেছে ।
পাকিস্তানে শিয়ারা (মোট জনসংখ্যার ১৫-২০%) বছরের পর বছর ধরে সন্ত্রাসীদের লক্ষ্যবস্তু । সিপাহ-ই-সাহাবার মতো উগ্রপন্থী সুন্নি গোষ্ঠীগুলো শিয়াদের ‘কাফের’ ঘোষণা করে তাদের হত্যার বৈধতা দেয় । বিশেষ করে কোয়েটা অঞ্চলের হাজারা সম্প্রদায়ের শিয়ারা মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৮ সাল থেকে ৫০০ জনেরও বেশি হাজারা শিয়া মুসলিম খুন হয়েছেন । উগ্রবাদী সুন্নি প্রক্সিদের বিরুদ্ধে জেনারেল কাসেম সোলেইমানির নেতৃত্বে IRGC-এর অধীনে মধ্যপ্রাচ্যের শিয়ারা একত্র হয়ে উল্লেখযোগ্য বিজয় অর্জন করেছে ।
বৈশ্বিক শিয়া প্রভাব এবং নেটওয়ার্কের একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র নিচে তুলে ধরা হলো:
Table 2: বৈশ্বিক শিয়া প্রভাবের কেন্দ্র এবং প্রক্সি নেটওয়ার্ক (ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষণ)
| দেশ/অঞ্চল | প্রধান শিয়া গোষ্ঠী/শাখা | বৈশ্বিক শিয়া নেটওয়ার্কে ভূমিকা | আঞ্চলিক সংঘাত/নিরাপত্তা প্রভাব |
| ইরান | দ্বাদশী (Twelver Shia) | আদর্শিক ও সামরিক কেন্দ্র। প্রক্সি নেটওয়ার্কের অর্থ ও অস্ত্র সরবরাহকারী। | শিয়া ‘চাঁদ’ (Shia Crescent) প্রতিষ্ঠার অভিযোগ, ইসরায়েল ও সৌদি আরবের সঙ্গে প্রক্সি যুদ্ধ। |
| ইরাক | দ্বাদশী (সংখ্যাগরিষ্ঠ) | ইরানের প্রভাব বলয়ে প্রবেশ, সরকারের নিয়ন্ত্রণ। | সুন্নি উগ্রবাদ (ISIS) এবং শিয়া মিলিশিয়াদের উত্থান। |
| লেবানন | দ্বাদশী | হিজবুল্লাহর সামরিক ও রাজনৈতিক কেন্দ্র। | ইসরায়েলের সঙ্গে দ্বন্দ্ব, অভ্যন্তরীণ শিয়া-সুন্নি উত্তেজনা বৃদ্ধি। |
| ইয়েমেন | জায়দি | ইরান সমর্থিত হুথি বিদ্রোহীরা। | আঞ্চলিক প্রক্সি যুদ্ধের মূল ক্ষেত্র। |
| পাকিস্তান | দ্বাদশী ও ইসমাইলি (সংখ্যালঘু) | উগ্রবাদী সুন্নি গোষ্ঠীর লক্ষ্যবস্তু। | অভ্যন্তরীণ সাম্প্রদায়িক নিপীড়ন ও নিরাপত্তা ঝুঁকি। |
চতুর্থ অধ্যায়: বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে শিয়া মুসলিম সমাজ ও নিরাপত্তা পরিস্থিতি
৪.১. বাংলাদেশের শিয়াদের ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক পটভূমি
বাংলাদেশের শিয়া সম্প্রদায়ের ইতিহাস বেশ প্রাচীন। ভারতবর্ষের মোঘল আমল থেকেই শিয়াদের প্রভাব বিদ্যমান ছিল। উদাহরণস্বরূপ, বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদদৌলা এবং শিক্ষাবিস্তারে অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী দানবীর হাজী মুহাম্মাদ মুহসিন ছিলেন শিয়া মুসলমান ।
বাংলাদেশের শিয়া সংস্কৃতির প্রধান কেন্দ্র হলো পুরান ঢাকার হোসাইনী দালান, যা কারবালার শহীদদের প্রতীকী নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত । প্রতি বছর মহররম মাসে হোসাইনী দালান থেকে পবিত্র আশুরা উপলক্ষে তাজিয়া মিছিল বের হয় । তাজিয়া মিছিলে শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখতে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কর্তৃক যেকোনো ধরনের ধারালো অস্ত্র, লাঠি, আতশবাজি বা পটকা বহন ও ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা হয় ।
৪.২. শিয়া-সুন্নি সহাবস্থানের ঐতিহ্য
বাংলাদেশের ধর্মীয় সহনশীলতার ঐতিহ্য দীর্ঘকালীন। এখানে শিয়া ও সুন্নি সম্প্রদায় শতাব্দিকাল ধরে শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করছে, এবং দেশে শিয়া-সুন্নি বিরোধের কোনো ঐতিহ্যবাহী নজির নেই । অনেক বাংলাদেশী মুসলমান শিয়া ও সুন্নিদের ধর্মতাত্ত্বিক মতভেদ সম্পর্কে খুব একটা অবগত নন, যা এক ধরনের মানসিক শান্তি বজায় রাখতে সহায়ক । স্থানীয় সুন্নি অধিবাসীরাও শিয়া সম্প্রদায়ের উপর যেকোনো হামলার ঘটনায় মর্মাহত হন এবং তাদের পাশে দাঁড়ানোর অঙ্গীকার করেন ।
৪.৩. সাম্প্রতিক নিরাপত্তা ঝুঁকি ও সন্ত্রাসবাদী হামলা
ঐতিহাসিক সম্প্রীতি সত্ত্বেও, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে শিয়াদের উপর টার্গেটেড হামলার ঘটনা মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাতের রেশ এখানে টেনে এনেছে। ২০১৫ সালে ঢাকায় শিয়াদের তাজিয়া মিছিলে হামলা হয়, যাতে দুইজন নিহত হন। এর কিছুদিন পর বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার হরিপুর গ্রামের মসজিদ-ই-আল মোস্তফায় নামাজ পড়া অবস্থায় গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে, যা ছিল দেশের কোনো মসজিদে প্রথম জঙ্গি হামলা। এই হামলায় মসজিদের মোয়াজ্জিন মোয়াজ্জেম হোসেন নিহত হন ।
এই হামলাগুলোর দায় আইএস (ISIS) স্বীকার করলেও, দেশের সরকার বারবার দেশে আইএসের কোনো অস্তিত্ব অস্বীকার করেছে । এই আক্রমণগুলো স্থানীয় বিরোধ থেকে সৃষ্ট নয়, বরং আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক কর্তৃক ‘আমদানি করা’ বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন । অধ্যাপক নাজমা বেগম বেনার নিউজকে জানান যে এই হামলা রাজনৈতিক এবং এতে আন্তর্জাতিক কোনো নেটওয়ার্ক জড়িত থাকতে পারে, যা বাংলাদেশের মানুষের চিন্তার বাইরে । এই ঘটনাগুলি ইঙ্গিত করে যে আন্তর্জাতিক উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলি বাংলাদেশের শান্তিপূর্ণ ধর্মীয় পরিবেশকে লক্ষ্যবস্তু করছে।
নিরাপত্তাজনিত আরেকটি গুরুতর উদ্বেগের বিষয় হলো, বগুড়ার শিয়া মসজিদে জঙ্গি হামলার চার বছর পার হয়ে গেলেও বিচার কার্যক্রম শুরু হয়নি । এই বিচারিক স্থবিরতা উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে বিচার ব্যবস্থা ও প্রতিরোধের দুর্বলতা প্রকাশ করে। তবে, ঘটনার পর সরকার শিয়া ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে (যেমন ৭টি শিয়া মসজিদে) এবং হোসাইনী দালানে পুলিশি নিরাপত্তা জোরদার করেছে ।
৪.৪. গণমাধ্যমে প্রতিবেদন বিশ্লেষণ: জে এইচ সুমন ও জনতা নিউজ-এর দৃষ্টিকোণ
ভূ-রাজনৈতিক সংঘাতের এই যুগে বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় গণমাধ্যমের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ম্যগাজিন জনতা নিউজ দেশের রাজনীতি, বাণিজ্য ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকে । প্রতিবেদক জে এইচ সুমন যদি এই বিষয়ে প্রতিবেদন তৈরি করেন, তবে তা অবশ্যই সাম্প্রতিক হামলাগুলোর তদন্ত এবং বিচারিক প্রক্রিয়ার স্থবিরতার ওপর আলোকপাত করবে ।
জনতা নিউজের মতো গণমাধ্যমগুলি মধ্যপ্রাচ্যের বিভেদ আমদানি করার চেষ্টার তীব্র সমালোচনা করবে। তারা সরকারকে অস্থিতিশীল করার পাঁয়তারা হিসেবে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলাকে চিহ্নিত করবে, যেমনটি অন্তর্বর্তী সরকারের ধর্ম উপদেষ্টা হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন । প্রতিবেদক সুমনের প্রতিবেদনে পাকিস্তানের মতো অঞ্চলে শিয়াদের ওপর নির্যাতনের ঘটনা উল্লেখ করে বাংলাদেশে এ ধরনের সহিংসতা বন্ধে কঠোর আইনগত পদক্ষেপের গুরুত্বের ওপর জোর দেওয়া হবে। ধর্মীয় সম্প্রীতি নষ্টকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার সরকারি প্রতিশ্রুতিকে কার্যকরী করতে গণমাধ্যমের জোরালো ভূমিকা পালন করা প্রয়োজন ।
পঞ্চম অধ্যায়: মতবিরোধের প্রকৃতি ও সহাবস্থানের পথে অন্তর্দৃষ্টি
৫.১. মতবিরোধের রাজনৈতিকীকরণ এবং বিভ্রান্তি
শিয়া ও সুন্নিদের মধ্যেকার ঐতিহাসিক মতবিরোধকে ইসলামের শত্রুরা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ব্যবহার করে আসছে। বিশ্লেষকদের মতে, ইসলামের শত্রুরাই ওয়াহাবি নামধারী একদল উগ্রপন্থী সুন্নিকে উস্কে দিয়েছে, যারা সহিংস দাঙ্গা বাধানোর জন্য সচেষ্ট । এই ওয়াহাবি মতাদর্শী গোষ্ঠীগুলি এতটাই চরমপন্থী যে তারা সুন্নিদের চার মাজহাবের ইমামগণ এবং তাদের অনুসারীদেরকেও কাফির বা হত্যার যোগ্য মনে করে ।
এই পরিস্থিতি দেখায় যে আধুনিক যুগের সহিংসতাগুলি ঐতিহাসিক ধর্মতাত্ত্বিক বিভেদের চেয়ে বরং ভূ-রাজনৈতিক প্রক্সি যুদ্ধ এবং উগ্র সালাফি/ওয়াহাবি মতাদর্শের বিস্তারের ফল। এই চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলি শান্তিপূর্ণ সুন্নিদেরকে ব্যবহার করে তাদের আদর্শ প্রচার করছে, যা বাংলাদেশের মতো সহাবস্থানের সংস্কৃতিকে মারাত্মক ঝুঁকির মুখে ফেলছে।
৫.২. সহাবস্থানের আন্তর্জাতিক মডেল থেকে শিক্ষা
যদিও শিয়া-সুন্নি সংঘাতের ইতিহাস গভীর, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ধর্মীয় উপদলীয় সংঘাত নিরসনের মডেল থেকে মুসলিম উম্মাহ শিক্ষা নিতে পারে। খ্রিস্টানদের মধ্যে ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্টদের মতো উপদলগুলি সপ্তদশ থেকে উনবিংশ শতকের প্রারম্ভ পর্যন্ত বহু রক্তাক্ত সংঘাত (যেমন ত্রিশ বছরব্যাপী যুদ্ধ) চালিয়েছে ।
তাদের এই সংঘাত নিরসনের পথ দুটি গুরুত্বপূর্ণ নীতির উপর নির্ভর করে: প্রথমত, ধর্মবেত্তাগণ পারস্পরিক স্বীকৃতি এবং আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে মতভিন্নতা বহাল রেখেও সহাবস্থানের কিছু সাধারণ শর্ত নির্ধারণ করেন। দ্বিতীয়ত, জনগণ উপলব্ধি করে যে ধর্মযুদ্ধ কেবল ক্ষতিই বয়ে আনে এবং এই উপলব্ধির ভিত্তিতে জনগণের পক্ষ থেকে সৃষ্ট চাপ ধর্মীয় নেতাদের সংঘাত পরিহার করতে বাধ্য করে ।
বাংলাদেশের মতো পরিবেশে, যেখানে স্থানীয় ঐতিহ্যগত শান্তি বজায় আছে, সেখানে বিদ্বেষপূর্ণ ধর্মতাত্ত্বিক আলোচনা উত্থাপন করা তিক্ততা বাড়াতে পারে। বরং পারস্পরিক স্বীকৃতি, ধর্মীয় সহনশীলতা এবং সংঘাতের বাহ্যিক উৎস (আন্তর্জাতিক উগ্রবাদ) নির্মূল করার ওপর মনোযোগ দেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
ষষ্ঠ অধ্যায়: উপসংহার ও ভবিষ্যতের পথ
শিয়া ইসলাম একটি গভীর ঐতিহাসিক ও ধর্মতাত্ত্বিক ভিত্তি নিয়ে গঠিত, যার মূল পরিচয় নবী (সা.)-এর উত্তরাধিকার এবং কারবালার ট্র্যাজেডি দ্বারা নির্ধারিত। আধুনিক ভূ-রাজনীতিতে, বিশেষত ইরানের উত্থান (শিয়া ভূ-রাজনীতির কেন্দ্র) মধ্যপ্রাচ্যে ক্ষমতার ভারসাম্যে বড় পরিবর্তন এনেছে, যা সৌদি জোটের সঙ্গে প্রক্সি সংঘাতকে তীব্র করেছে। শিয়ারা সংখ্যায় সংখ্যালঘু হলেও ইরানের মতো কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতার কারণে তারা সুসংগঠিতভাবে আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছে।
অন্যদিকে, বাংলাদেশের শিয়া মুসলিম সম্প্রদায় শত বছরের পুরোনো সহাবস্থানের ঐতিহ্য বহন করলেও, ২০১৫ সালের হামলাগুলি প্রমাণ করেছে যে আন্তর্জাতিক শিয়া সুন্নি সংঘাতের কারণ এবং এর বিষাক্ত প্রভাব স্থানীয়ভাবে আমদানি করা হয়েছে। এই হামলাগুলি স্থানীয় নয়, বরং আন্তর্জাতিক জঙ্গি নেটওয়ার্কের মাধ্যমে পরিচালিত হয়েছে, যা দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের পাঁয়তারা।
নিরাপত্তা ও বিচারিক পর্যবেক্ষণ: সরকারের উচিত আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী নেটওয়ার্কের স্থানীয় সংযোগগুলি খুঁজে বের করা এবং ২০১৫ সালের শিয়া মসজিদে হামলার মামলাগুলোর বিচার দ্রুত শুরু করা । বিচারহীনতার সংস্কৃতি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য হুমকি।
গণমাধ্যমের দায়িত্ব: জনতা নিউজ এবং জে এইচ সুমন-এর মতো দায়িত্বশীল গণমাধ্যমকে ধর্মতাত্ত্বিক শিয়া সুন্নি বিভাজন বিতর্ক উস্কে না দিয়ে, বরং বিভেদ সৃষ্টিকারীদের চক্রান্ত ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের অপচেষ্টার বিরুদ্ধে তথ্যভিত্তিক এবং কঠোর প্রতিবেদন প্রকাশ করা উচিত। সকল ধর্মীয় পক্ষকে আন্তর্জাতিক মডেলের শিক্ষানুযায়ী পারস্পরিক স্বীকৃতি ও সহিষ্ণুতা বজায় রেখে বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় সচেষ্ট হতে হবে।
