সুন্নি ইসলাম: বৈশ্বিক ভূ-রাজনীতি থেকে বাংলাদেশের ধর্মীয় সংস্কৃতি – ইতিহাস, বিতর্ক ও শিয়াদের সাথে সম্পর্ক (প্রতিবেদক জে এইচ সুমন/জনতা নিউজ সূত্র)
প্রতিবেদক: জে এইচ সুমন (জনতা নিউজ ম্যাগাজিন)
(সুন্নি ইসলাম, বাংলাদেশের সুন্নি, হেফাজতে ইসলাম, শিয়া সুন্নি দ্বন্দ্ব, ওয়াহাবি মতবাদ, কওমি মাদ্রাসা সংস্কার, জনতা নিউজ)
১. ভূমিকা: সুন্নি উম্মাহর বৈচিত্র্য ও আজকের চ্যালেঞ্জসমূহ
১.১ সুন্নি পরিচিতি: আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’য়াত এবং বিশ্বজনীন অবস্থান
সুন্নি মুসলিমরা বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে বৃহত্তম সম্প্রদায় হিসেবে পরিচিত, যারা মোট মুসলিম জনসংখ্যার প্রায় ৯০ শতাংশের প্রতিনিধিত্ব করে । তাদের আদর্শিক পরিচয় হলো ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’য়াত’ (সংক্ষেপে আহল আস-সুন্নাহ), যার মর্মার্থ হলো নবি মুহাম্মাদ (সা.)-এর সুন্নাহ (বাণী ও কর্ম) এবং উম্মাহর ঐক্যের অনুসারী । এই নামটির উৎপত্তিই হয়েছে ‘সুন্নাহ’ শব্দ থেকে।
নবি মুহাম্মাদের (সা.) জীবদ্দশায় মুসলিমদের মধ্যে সুন্নি, শিয়া বা অন্য কোনো নামে কোনো সম্প্রদায় ছিল না; বিভাজনের সূত্রপাত ঘটে তাঁর ইন্তেকালের পর নেতৃত্ব বা উত্তরসূরি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে । সুন্নিরা সেই অংশ যারা নবির মৃত্যুর পর সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে নির্বাচিত খলিফা হজরত আবু বকরকে (রা.) মেনে নিয়েছিল । এটি খিলাফত ব্যবস্থায় ‘শুরা’ বা নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিনিধিত্বের ধারণাকে সুন্নি ইসলামের একটি মৌলিক রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে ।
সুন্নিদের এই পরিচয়টি কেবল ধর্মীয় বিশ্বাসভিত্তিক নয়, এটি ঐতিহাসিক একটি রাজনৈতিক অবস্থানও বটে। এটি শিয়াদের ‘মনোনীত ইমামত’ ধারণার বিপরীতে ‘নির্বাচিত খিলাফত’ ধারণাকে তুলে ধরে। এই নির্বাচনের মাধ্যমেই রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। এই ঐতিহাসিক ভিত্তিই মুসলিম উম্মাহর মধ্যে একটি একক রাজনৈতিক নেতৃত্বের (খিলাফত/ইমামত) আকাঙ্ক্ষার জন্ম দিয়েছে , যা আধুনিক সময়েও ইসলামি রাজনৈতিক আন্দোলনের একটি মূল প্রেরণা হিসেবে কাজ করে।
১.২ প্রতিবেদনের উদ্দেশ্য এবং এসইও কৌশল
এই প্রতিবেদনটির লক্ষ্য হলো সুন্নি উম্মাহর ঐতিহাসিক, ধর্মতাত্ত্বিক এবং ভূ-রাজনৈতিক স্তরগুলোর একটি গভীর বিশ্লেষণ উপস্থাপন করা। বিশেষত, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ধর্মীয় বিতর্ক, যেমন কওমি-বেরেলভি সংঘাত, কওমি শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা, এবং রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে হেফাজতে ইসলামের উত্থানকে গুরুত্ব সহকারে আলোচনা করা হবে। পাশাপাশি, বৈশ্বিক স্তরে সৌদি আরবের ওয়াহাবি মতবাদ থেকে সরে আসার মতো বড় ধরনের পরিবর্তন এবং শিয়া-সুন্নি সম্পর্কের ভূ-রাজনৈতিক দিকগুলোও পরীক্ষা করা হয়েছে। এই বিশদ বিশ্লেষণ ধর্মীয় রাজনীতি, ইতিহাস এবং সামাজিক প্রেক্ষাপটের একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র প্রদান করবে।
২. সুন্নি ইসলামের মৌলিক ভিত্তি ও ঐতিহাসিক কাঠামো
২.১ খিলাফত বিতর্ক ও প্রাথমিক বিভাজন: শুরা ও নির্বাচনের গুরুত্ব
ইসলামের ইতিহাসে প্রথম এবং প্রধান বিভাজনটি মূলত রাজনৈতিক নেতৃত্বের (খলিফা বা ইমাম) নির্বাচন নিয়ে শুরু হয়েছিল । সুন্নি অবস্থান হলো, নবি (সা.) কাউকে সরাসরি উত্তরসূরি মনোনীত না করে উম্মাহর জন্য নেতা নির্বাচনের পথ উন্মুক্ত রেখেছিলেন । এই কারণে তাঁরা হজরত আবু বকরকে (রা.) প্রথম খলিফা হিসেবে মেনে নেন, যা নির্বাচনের মাধ্যমে খিলাফতের পথ সুগম করে।
খিলাফতকে একটি সুবিচার, জবাবদিহিতা এবং মানবাধিকার সচেতন শাসন ব্যবস্থা হিসেবে কল্পনা করা হয়েছিল । খলিফার প্রতি বাইআত বা আনুগত্যের শপথ নেওয়া এই ব্যবস্থার একটি মূল শর্ত ছিল, যা আল্লাহর অবাধ্যতা ছাড়া খলিফার প্রতি আনুগত্য করার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়া বোঝায় । ইসলামের প্রাথমিক যুগে ইমাম নিযুক্ত করাকে উম্মাহ সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিত, কারণ অনেক শরয়ী দায়িত্বপালন ইমামের ওপর নির্ভরশীল ছিল ।
এই গুরুত্বটি নির্দেশ করে যে, নবির (সা.) সময়ের অব্যবহিত পরে নেতৃত্বের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা ছিল উম্মাহর জন্য একটি অত্যাবশ্যকীয় ধর্মীয় কর্তব্য। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছিলেন, “যে তাঁর সময়ের ইমামকে না চিনে মারা যায়, তার মৃত্যু জাহেলিয়্যাতের মৃত্যু” । এই উক্তিটির ঐতিহাসিক প্রভাব সুদূরপ্রসারী। যদিও উসমানীয় খিলাফতের পতন হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধে এবং আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় তা সংবিধান দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয় , তবুও খিলাফতের আদর্শিক গুরুত্ব থেকেই যায়। আধুনিক রাজনৈতিক ইসলামি দলগুলো এই ‘জাহেলিয়্যাতের মৃত্যু’ এড়ানোর জন্য একক নেতা বা ইমামের প্রয়োজনীয়তার ধারণাকে শক্তিশালী করে, যার ফলে তারা রাষ্ট্রের ওপর ধর্মীয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে।
২.২ সুন্নি ফিকহের মূলস্তম্ভ ও মাযহাবসমূহ
সুন্নি ইসলামের আইনশাস্ত্র বা ফিকহ মূলত শরিয়াহর চারটি উৎসের ওপর ভিত্তি করে গঠিত: কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা (ঐকমত্য) ও কিয়াস (তুলনা) । সুন্নি মুসলিমদের মধ্যে আইন ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে কিছু মতপার্থক্য দেখা যায়, যা চারটি প্রধান আইনগত ঘরানা বা মাযহাবের জন্ম দিয়েছে। এই মাযহাবগুলো হলো: হানাফি, মালিকি, শাফিয়ি, ও হাম্বলি ।
এই চারটির মধ্যে হানাফি মাযহাবটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। পারসিক ইমাম আবু হানিফা (৬৯৯-৭৬৭ খ্রি.) এই মাযহাবের প্রবক্তা। অন্য মাযহাবগুলোর তুলনায় হানাফি মাযহাবে প্রজ্ঞা ও যুক্তির ওপর অনেক বেশি গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে । ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারত, আফগানিস্তান এবং মধ্য এশিয়াসহ বৃহৎ মুসলিম অঞ্চলগুলোতে হানাফি মাযহাব প্রভাবশালী। এই ব্যাপক ভৌগোলিক প্রসারের কারণ হলো মধ্যযুগে এই মাযহাব মুঘল ও উসমানীয়দের মতো প্রভাবশালী শাসকগোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিল। উদাহরণস্বরূপ, সপ্তদশ শতাব্দীতে বাদশাহ আওরঙ্গজেবের আদেশক্রমে শেখ নিজামুদ্দিন ব্রহ্মপুরীর নেতৃত্বে ৫০০ জন ওলামার মাধ্যমে সংকলিত হয়েছিল ফতোয়ায়ে আলমগিরি (যা ফতোয়ায়ে হিন্দিয়্যাহ নামেও পরিচিত), যা এই অঞ্চলের সুন্নি আইনের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে । এই আইনি ভিত্তি দক্ষিণ এশিয়ার দেওবন্দি ও বেরেলভি উভয় ধারার পূর্ববর্তী ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে।
৩. বাংলাদেশের সুন্নি মানচিত্র: হানাফি ঐতিহ্য ও অভ্যন্তরীণ মতবাদ
৩.১ বাংলাদেশে হানাফি মাযহাবের ঐতিহাসিক ও প্রায়োগিক প্রাধান্য
বাংলাদেশের মুসলিম সমাজ ঐতিহাসিকভাবে হানাফি মাযহাবের অনুসারী। এই মাযহাবটি দেশের ধর্মীয় পরিচয়ের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিশ্বের বহু মুসলমান হানাফি মাযহাবের অনুসারী এবং বাংলাদেশেও সবচেয়ে বেশি সংখ্যক সুদক্ষ আলিম-ওলামা এবং পীর-মাশাইখ এই ধারার অনুসারী। অনেক ক্ষেত্রে স্থানীয়ভাবে হানাফি মাযহাবকে ‘সর্বশ্রেষ্ঠ মাযহাব’ হিসেবে প্রচার করা হয় । এটি প্রমাণ করে যে, বাংলাদেশের ধর্মীয় চর্চা ও ফিকহের ক্ষেত্রে এই মাযহাবের স্থিতাবস্থা সুদূরপ্রসারী।
৩.২ দেওবন্দি বনাম বেরেলভি: মতাদর্শিক সংঘাতের মূল কারণ
ভারতীয় উপমহাদেশে সুন্নি ইসলামের অভ্যন্তরে দুটি প্রধান উপধারা দেখা যায়: দেওবন্দি এবং বেরেলভি। যদিও উভয় ধারাই ফিকহের ক্ষেত্রে ইমাম আবু হানিফার অনুসরণ করে, তবুও আকীদা (বিশ্বাস) ও আমলের (অনুশীলন) ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে তীব্র মতবিরোধ বিদ্যমান।
দেওবন্দি ফিকাহ গঠিত হয় ইসলামি শরিয়ার হানাফি ব্যাখা ও উসুলের উপর ভিত্তি করে । এই ঘরানা কঠোরভাবে বিদ’আত (ধর্মীয় উদ্ভাবন) পরিহারের উপর জোর দেয়। তাদের কাছে কোনো বিষয়কে ধর্মের অংশ হিসেবে গ্রহণ করা, যা বিশেষভাবে বা সাধারণভাবে দ্বীনের অংশ নয়, তা বিদ’আত । তারা মনে করে, সত্যিকার অর্থে বিদ’আত সবসময়ই খারাপ এবং ‘ভালো বিদ’আত’ বলে যা প্রচলিত আছে, তা কেবল আকারে বিদ’আত হলেও বাস্তবে তা ধর্মের কিছু সাধারণ নীতির অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ায় তা সুন্নাত হতে পারে ।
অন্যদিকে, বেরেলভি ঘরানাটি ইমাম আহমদ রেজা খান বেরেলভির (১৮৫৬-১৯২১) আদর্শের অনুসারী । তারা প্রথাগত সুফিবাদ, মাজার পূজা, ওরস, মিলাদ এবং রাসূল (সা.) ও অলীদের প্রতি বিশেষ ভক্তি সমর্থন করে। দেওবন্দি ও আহলে হাদিস ঘরানার অনুসারীরা এসব আমলকে প্রায়শই শিরক বা বিদ’আত হিসেবে গণ্য করে, যার ফলে তাদের মধ্যে তীব্র ধর্মতাত্ত্বিক সংঘাত বিদ্যমান। কিছু কঠোরপন্থী দেওবন্দি ঘরানা বেরেলভিদেরকে ওয়াহাবি মতবাদ আমদানি করা এবং কুফরি আক্বীদার ধারক হিসেবেও সমালোচনা করে থাকে ।
এই মতাদর্শিক সংঘাত নিছক ধর্মতাত্ত্বিক বিরোধ নয়। এটি একাধারে সুফি ঐতিহ্য ও স্থানীয় লোক-সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল প্রথাগত ইসলাম (বেরেলভি) এবং কঠোর ধর্মীয় শুদ্ধিবাদের (দেওবন্দি ও সালাফি/আহলে হাদিস) মধ্যকার সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার লড়াই। এই অভ্যন্তরীণ বিভাজন বাংলাদেশের বৃহত্তর সুন্নি সমাজকে সাংগঠনিকভাবে দুর্বল করতে পারে।
আরেকটি সংখ্যালঘু সুন্নি গোষ্ঠী হলো আহলে হাদিস, যাদের অর্থের আভিধানিক অর্থ হলো ‘হাদিসের অনুসারী’। এই গোষ্ঠী সালাফিদের মতোই কুরআন ও সহিহ হাদিসকে ইসলামের একমাত্র উৎস হিসেবে গ্রহণ করে এবং কোনো নির্দিষ্ট মাযহাবের তাকলিদ (অন্ধ অনুসরণ) প্রত্যাখ্যান করে । তারা পীর-ফকির, মাজার পূজা, সুফিবাদ ইত্যাদি বিষয়গুলোর ঘোর বিরোধী ।
বাংলাদেশের সুন্নি সমাজে ফিকহি ঘরানার তুলনামূলক চিত্রটি নিম্নরূপ:
বাংলাদেশের সুন্নি সমাজে ফিকহি ঘরানার তুলনামূলক চিত্র
| ধারা/মাযহাব | ধর্মতাত্ত্বিক উৎস (আকীদা) | মূল প্রায়োগিক ভিন্নতা | রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা (উদাহরণ) |
| হানাফি (প্রথাগত) | মাতুরিদি/আশআরি | ফিকহি স্থিতাবস্থা, যুক্তির ওপর গুরুত্ব | সাধারণত অ-রাজনৈতিক/সুফিবাদী |
| দেওবন্দি (কওমি) | মাতুরিদি/আশআরি | বিদ’আত কঠোরভাবে বর্জন , তাকলিদ অনুসরণ | হেফাজতে ইসলাম, চরম রাজনৈতিক সক্রিয়তা |
| বেরেলভি | মাতুরিদি/আশআরি | রাসূল (সা.) ও অলীদের প্রতি বিশেষ ভক্তি, ওরস ও মিলাদ সমর্থন | আঞ্জুমান ট্রাস্ট, রাজনৈতিকভাবে মধ্যপন্থী |
| আহলে হাদিস/সালাফি | আসারি/সালাফি | তাকলিদ প্রত্যাখ্যান, কেবল কুরআন ও সহিহ হাদিস অনুসরণ | রাজনৈতিকভাবে নিষ্ক্রিয়, কিন্তু ধর্মীয় শুদ্ধিবাদের প্রচারক |
৪. সুন্নি অ্যাক্টিভিজম ও দেশের রাজনীতি: হেফাজতে ইসলামের উত্থান
৪.১ কওমি মাদ্রাসা ব্যবস্থা: শিক্ষা, স্বকীয়তা এবং সংস্কারের দ্বন্দ্ব
বাংলাদেশে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থার একটি সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে, যা প্রাক-ব্রিটিশ যুগে শুরু হয়েছিল এবং ব্রিটিশ আমলে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় মাদ্রাসা শিক্ষার বিকাশ ঘটে । বর্তমানে দেশে ১৯ হাজারের বেশি কওমি মাদ্রাসা রয়েছে । এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর নেতৃত্ব সরকারের নিবন্ধনের আওতায় আসতে রাজি নন, কারণ তারা মনে করেন এতে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষার স্বকীয়তা থাকবে না । প্রতিষ্ঠার জন্য তাদের কোনো বোর্ড বা সরকারের প্রশাসনের অনুমতির প্রয়োজন হয় না, যা শিক্ষার গুণগত মান এবং শৃঙ্খলা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি করেছে ।
শিক্ষাব্যবস্থার এই স্বকীয়তা বজায় রাখার দাবির বিপরীতে সরকারের অবস্থান হলো, কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা যাতে কর্মক্ষেত্রের জন্য যোগ্য এবং দক্ষ হয়ে গড়ে ওঠে, তার জন্য শিক্ষা কার্যক্রমকে যুগোপযোগী করা প্রয়োজন । সরকার কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ দাওরায়ে হাদিস ডিগ্রিকে মাস্টার্সের মর্যাদা দিয়েছে। কিন্তু একই সাথে সরকার চাইছে দশম শ্রেণির সমমর্যাদা পর্যন্ত কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের বাংলা, ইংরেজি এবং অংক শেখানো হোক, যাতে তারা জাতীয় পাঠ্যক্রমের শিক্ষা নিয়ে কর্মদক্ষ হতে পারে ।
এখানে একটি গভীর সামাজিক সমস্যা নিহিত রয়েছে। সরকার বা বিশ্লেষকদের মতে, শুধু ধর্মতত্ত্বের ওপর শিক্ষা নিয়ে এই বিশাল জনগোষ্ঠীর কর্মযোগ্যতা সৃষ্টি হয় না। ফলে তারা কোথাও চাকরি পাচ্ছে না এবং একটি বিশাল জনগোষ্ঠী অর্থনৈতিক সমস্যায় ভুগছে । কওমি মাদ্রাসার অ-যুগোপযোগী সিলেবাসের কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে কর্মদক্ষতার অভাব সৃষ্টি হচ্ছে, তা সমাজে একটি অসন্তুষ্ট জনগোষ্ঠী তৈরি করে। এই অসন্তোষ পরবর্তীতে রাজনৈতিক দলগুলো দ্বারা ধর্মীয় আবেগ ও রাজনৈতিক ইসলামকে উসকে দেওয়ার কাজে ব্যবহৃত হতে পারে ।
৪.২ হেফাজতে ইসলামের রাজনীতি ও কট্টরপন্থার স্বরূপ
হেফাজতে ইসলাম প্রাথমিকভাবে নিজেদের অরাজনৈতিক ইসলামি সংগঠন হিসেবে দাবি করলেও এর কার্যক্রম বরাবরই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে পরিচালিত হয়েছে । কট্টরপন্থী এই সংগঠনটি স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং মুজিববর্ষের উদযাপনকে ভালো চোখে দেখেনি। তারা কৌশলগতভাবে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যকে মূর্তি হিসেবে উপস্থাপন করে গোটা দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা চালায় । তাদের এই পদক্ষেপ ছিল মূলত রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল।
তাদের সাম্প্রতিক আন্দোলনের পেছনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরের বিরোধিতা লোক দেখানো কারণ হলেও, মূল কারণ ছিল জামায়াত-বিএনপি’র সহযোগী হিসেবে একটি নব্য রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়ে রাষ্ট্রক্ষমতার স্বাদ গ্রহণ করা । হেফাজতে ইসলামের মতো গোষ্ঠীগুলোর উত্থান প্রমাণ করে যে, বাংলাদেশে সুন্নি অ্যাক্টিভিজম এখন কেবল ‘রক্ষণশীল চেতনা’ ধারণ করে না, বরং এটি সরাসরি রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। এই চরম রাজনৈতিক সক্রিয়তা দেশের সাংবিধানিক ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণার প্রতি গুরুতর চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে ।
এক্ষেত্রে ওয়াজ মাহফিল সংস্কৃতি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করে। ওয়াজ মাহফিল একসময় সামাজিক ব্যাধি (ইভটিজিং, যৌতুক, নারী নির্যাতন, জঙ্গিবাদ) মোকাবেলায় জনসচেতনতা সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত । কিন্তু বর্তমানে কিছু বক্তা পারস্পরিক গালাগাল, দেশ-বিরোধী এবং আন্তঃধর্মীয় সম্পর্ক ক্ষুণ্ণকারী উসকানিমূলক বক্তব্য প্রদানের জন্য এই মঞ্চ ব্যবহার করছেন । উগ্রবাদী গোষ্ঠীর উত্থানের ফলে দেশের উৎসবমুখর পরিবেশ (যেমন ওরস, মেলা) আতঙ্কিত হয় এবং বহু বাৎসরিক অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায় ।
৪.৩ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও গণমাধ্যমের ভূমিকা (জে এইচ সুমন ও জনতা নিউজ রেফারেন্স)
বাংলাদেশে শিয়া-সুন্নি সম্প্রদায়ের মধ্যে শতাব্দী প্রাচীন শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বিদ্যমান; এখানে বিরোধের কোনো নজির নেই । এই সম্প্রীতি দেশের সহজাত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতিফলন। যখন উগ্রবাদী গোষ্ঠী রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করতে ধর্মীয় বিভেদ উসকে দেয় , তখন গণমাধ্যমের ভূমিকা অপরিহার্য হয়ে ওঠে।
ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে সাংবাদিকতা ও প্রতিবেদনের গুরুত্ব অনস্বীকার্য । ম্যগাজিন জনতা নিউজ (Janata News) মতো প্রতিষ্ঠানগুলো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করেছে । ধর্মীয় সংস্কৃতি এবং সাম্প্রদায়িক সহাবস্থান নিয়ে কাজ করা প্রতিবেদক জে এইচ সুমন-এর মতো ব্যক্তিদের আলোচনা নির্দেশ করে যে, ধর্মীয় সংস্কৃতি ও গণমাধ্যমে ভারসাম্যপূর্ণ ও সম্প্রীতিমূলক আলোচনার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। বস্তুত, গণমাধ্যমের নিরপেক্ষ এবং সম্প্রীতিমূলক ভূমিকা বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী শান্তিপূর্ণ ধর্মীয় সহাবস্থানকে রক্ষা করতে এবং রাজনৈতিক ইসলামি শক্তির অপপ্রয়াসকে মোকাবেলা করতে অপরিহার্য।
৫. বৈশ্বিক সুন্নি ক্ষমতা ও ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তন
৫.১ ওয়াহাবি মতবাদের ঐতিহাসিক উৎপত্তি ও সৌদি আরবের ভূমিকা
ওয়াহাবি মতবাদ একটি কঠোর শুদ্ধিবাদী আন্দোলন, যা আরবের ধর্মীয় নেতা মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহ্হাব (১৭০৩-১৭৯২ খৃ.) কর্তৃক অষ্টাদশ শতাব্দীতে প্রচারিত হয়। তিনি তৎকালীন আরবে প্রচলিত কবর পূজা, মানত করা, কবরে সাজদা করা এবং অন্যান্য প্রকারের কুসংস্কার, শিরক ও বিদ’আতের তীব্র প্রতিবাদ করেন ।
১৭৪৫ সালে দিরইয়া্য নামক গ্রামের শাসক আমীর মুহাম্মাদ ইবনু সাঊদ তাঁর সাথে যোগ দেন, যা প্রথম সৌদি রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করে । এই আন্দোলন ১৮০৪ সালের মধ্যে মক্কা-হিজাজ সহ আরব উপদ্বীপের অধিকাংশ এলাকা নিজেদের অধীনে নিয়ে আসে। তৎকালীন তুর্কি খিলাফত এই নতুন রাজত্বের উত্থানকে তাদের আধিপত্য ও নেতৃত্বের জন্য ক্ষতিকর মনে করে । তুর্কি খলীফা দরবারের আলিমগণের মাধ্যমে ওয়াহাবিদেরকে ধর্মদ্রোহী, কাফির ও ইসলামের অন্যতম শত্রু হিসেবে ফাতওয়া প্রচার করেন এবং তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযান চালানোর নির্দেশ দেন । এই ঐতিহাসিক বিরোধ প্রমাণ করে যে সুন্নি মতবাদ কখনই একক ছিল না; বরং ভূ-রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং ধর্মীয় কর্তৃত্বের মধ্যে সবসময়ই তীব্র দ্বন্দ্ব ছিল। ঐতিহাসিকভাবে হানাফি মতাদর্শী তুর্কি খিলাফত কর্তৃক এই চরম বিরোধিতার মাধ্যমে বোঝা যায়, ধর্মীয় কর্তৃত্ব প্রায়শই রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
৫.২ সৌদি আরবের ধর্মীয় সংস্কার: ওয়াহাবি-পরবর্তী যুগে প্রবেশ
ওয়াহাবি মতবাদকে ইসলামের সবচেয়ে কট্টরপন্থি মতবাদগুলোর অন্যতম হিসেবে বিবেচনা করা হয় । তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সৌদি আরবের বর্তমান প্রশাসন ধর্মীয় অনুশাসনের চেয়ে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারকে অধিক গুরুত্ব দিচ্ছে। এই উদ্যোগের প্রধান কারণ হলো, দেশটি সম্পর্কে বিনিয়োগকারী এবং আন্তর্জাতিক ভ্রমণকারীদের যে নেতিবাচক ধারণা আছে, তা দূর করা এবং দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক-সামাজিক কাঠামোকে ঢেলে সাজানো ।
সৌদি আরবের এই সংস্কার কার্যক্রমগুলো অভূতপূর্ব। উদাহরণস্বরূপ, একসময়কার আতঙ্ক ধর্মীয় পুলিশের ক্ষমতা এখন প্রায় নিষ্ক্রিয় । এছাড়া, স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে অমুসলিমদের প্রতি বিদ্বেষমূলক ভাষা বাতিল করা হয়েছে। সিনেমা হল স্থাপন এবং নারীদের গাড়ি চালানোর অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এমনকি, মসজিদের মাইকের উচ্চ শব্দ কমিয়ে রাখার নির্দেশনাও জারি করা হয়েছে, যা রক্ষণশীল ওয়াহাবি অনুশাসন থেকে সরে আসার ইঙ্গিত দেয় ।
সৌদি আরবের এই ‘ওয়াহাবি-পরবর্তী যুগে’ প্রবেশ বৈশ্বিক সুন্নি অ্যাক্টিভিজমের জন্য একটি বিশাল বাঁকবদল। বহু কট্টরপন্থী এবং সালাফি গ্রুপ, যারা এতদিন সৌদি অর্থায়ন ও মতাদর্শিক সমর্থন পেত, তারা এখন শূন্যতা অনুভব করবে। এই পরিবর্তন বিশ্বব্যাপী ধর্মীয় উগ্রবাদের অর্থের উৎস এবং মতাদর্শিক দিকনির্দেশনায় নাটকীয় পরিবর্তন আনতে পারে, যা বিশ্বজুড়ে সুন্নি আন্দোলনগুলোকে ভিন্ন পথে চালিত করবে।
৫.৩ অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কো-অপারেশন (ওআইসি): প্রাসঙ্গিকতার সংকট
ওআইসি মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে বড় জোট, যা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আল-আকসায় ইসরাইলের অগ্নিসংযোগের পরিপ্রেক্ষিতে জেরুজালেম ইস্যুকে কেন্দ্র করে । খেলাফতব্যবস্থার অনুপস্থিতিতে মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বশূন্যতা পূরণের একটি চেষ্টা হিসেবে এর প্রতিষ্ঠা ছিল জনমনে আশাব্যঞ্জক ।
কিন্তু সংস্থাটির প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে বর্তমানে গুরুতর সংকট দেখা দিয়েছে। ওআইসি গঠনের মূল কার্যকারণ (জেরুজালেম) থেকে সৌদি আরবসহ প্রভাবশালী মুসলিম দেশগুলো দূরে সরে গেছে এবং ইসরাইলের সঙ্গে তাদের সখ্যতা বাড়িয়েছে । এছাড়া, সৌদি আরব এবং ইরানের পরস্পর বিরোধী অবস্থান ও আঞ্চলিক আধিপত্যের লড়াই সংস্থা হিসেবে ওআইসিকে দুর্বল করেছে। এই আঞ্চলিক স্বার্থের সংঘাত ওআইসি’র ঐক্য ও সংহতিকে সংকটে ফেলেছে ।
বিশ্লেষকদের মতে, রোহিঙ্গা সমস্যা, সিরিয়া ও ইয়েমেনের মানবিক সংকট মোকাবিলায় ওআইসি’র ভূমিকা হতাশাজনক। কাঠামোগত সংস্কারের প্রস্তাবনা থাকা সত্ত্বেও তা আজও বাস্তবায়ন হয়নি। ওআইসি এখন দিনে দিনে সম্মেলন ও অঙ্গীকার ঘোষণাসর্বস্ব সংস্থায় পরিণত হচ্ছে । এই দুর্বলতা সুন্নি বিশ্বের একক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্যর্থতাকে তুলে ধরে।
৬. শিয়াদের সাথে সুন্নিদের সম্পর্ক ও সংঘাতের মাত্রা
৬.১ ঐতিহাসিক বিরোধের জন্ম: ইমামত ও খিলাফতের আদর্শিক ভিন্নতা
শিয়া ও সুন্নিদের মধ্যে বিভাজনের মূল কারণটি হলো নবি মুহাম্মাদের (সা.) উত্তরসূরি বা নেতৃত্ব নিয়ে আদর্শিক পার্থক্য । সুন্নিরা মনে করে নবি (সা.) নেতৃত্ব নির্বাচনের পথ উম্মাহর জন্য উন্মুক্ত রেখে গেছেন, যেখানে খলিফা সর্বসম্মতিক্রমে নির্বাচিত হবেন (শুরা) । অন্যদিকে, শিয়ারা বিশ্বাস করে নবি (সা.) তাঁর চাচাতো ভাই ও জামাতা হজরত আলীকে উত্তরসূরি হিসেবে মনোনীত করেছিলেন। শিয়ারা নেতৃত্বকে আহলে বাইত (নবির পরিবার) থেকে আসা ঐশ্বরিক ইমামদের এক বিশেষ ধারাবাহিকতা হিসেবে দেখে ।
হজরত আলীর (রা.) উত্থান-পতন এবং সবশেষে তাঁর পুত্র হজরত হোসেইনের হত্যাযজ্ঞ এই বিভেদকে স্থায়ী ও মর্মান্তিক রূপ দেয় । সুন্নি মুসলমানরা হজরত আলীকে চতুর্থ খলিফা হিসেবে সম্মান করেন এবং শিয়া মুসলমানদের সব ইমামকেই উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন মুসলমান হিসেবে শ্রদ্ধা করেন, যদিও তাঁরা সবাই আল্লাহর মনোনীত খলিফা বা ইমাম ছিলেন বলে সুন্নিরা মনে করেন না ।
শিয়া-সুন্নি বিভাজনের ঐতিহাসিক ও মতাদর্শিক ভিত্তি নিচে তুলে ধরা হলো:
শিয়া-সুন্নি বিভাজনের ঐতিহাসিক ও মতাদর্শিক ভিত্তি
| বিভেদের ক্ষেত্র | সুন্নি (আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’য়াত) | শিয়া (শিয়াতে আলী) |
| নেতৃত্ব/খিলাফতের মূলনীতি | শুরা (নির্বাচন) দ্বারা খলিফা নির্বাচন। নেতৃত্ব অস্থায়ী | আহলে বাইত (মনোনীত ইমামত)। নেতৃত্ব ঐশ্বরিক |
| শরিয়তের উৎস | কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা, কিয়াস, চার মাযহাবের অনুসরণ | কুরআন, সুন্নাহ (আহলে বাইত কর্তৃক বর্ণিত), আকল (যুক্তি), ইসনা আশারি/জাফরি ফিকহ |
| জনসংখ্যার অনুপাত | বিশ্বের মুসলিমদের প্রায় ৯০% | বিশ্বের মুসলিমদের প্রায় ১০-১৫% |
| রাজনৈতিক কেন্দ্র | ঐতিহাসিকভাবে দামেস্ক/বাগদাদ/ইস্তাম্বুল, বর্তমানে রিয়াদ/কায়রো | ঐতিহাসিকভাবে কুফা, বর্তমানে কোম (ইরান) |
৬.২ আধুনিক ভূ-রাজনৈতিক প্রক্সি যুদ্ধ: ইরান-সৌদি প্রতিদ্বন্দ্বিতা
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শিয়া ও সুন্নিদের মধ্যেকার সম্পর্ক ক্রমবর্ধমান সংঘাতে চিহ্নিত হয়েছে । ১৯৭৯ সালের ইরানি বিপ্লব, যা ইরানকে শিয়া ধর্মগুরুদের শাসনাধীনে নিয়ে আসে, এবং ইরাক যুদ্ধের পর শিয়াদের শক্তিশালী আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে উত্থান ঘটে। এই পরিবর্তনগুলো সুন্নি-আরব আধিপত্য নিয়ে উদ্বেগ বাড়ায় ।
বর্তমানে শিয়া-সুন্নি সংঘাত ভূ-রাজনৈতিক প্রক্সি যুদ্ধের মাধ্যমে তীব্রতা লাভ করেছে, যার প্রধান কেন্দ্রবিন্দু হলো ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে আঞ্চলিক আধিপত্য বিস্তারের লড়াই । ইয়েমেনে হুথি বিদ্রোহীরা, লেবাননে হেজবুল্লাহ—এই উভয় শিয়া গোষ্ঠীই তেহরানের মিত্র। এই সংঘাতের পেছনে ধর্মীয় বিভাজন একটি বড় ভূমিকা রাখলেও, আঞ্চলিক আধিপত্য ও তেলের বাজার দখল করার মতো অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থই মুখ্য ।
অনেক শক্তি এবং গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক কাজ করছে যাতে এই সংঘাত চলতেই থাকে। পশ্চিমারা প্রায়শই ধর্ম, সংস্কৃতি ও জাতিগত পার্থক্যকে ব্যবহার করে ‘ভাগ করো, শাসন করো’ নীতি অবলম্বন করে তাদের আধিপত্য বজায় রাখার কৌশল নেয় । তবে ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের সামনে ধর্মীয় বিভাজন গৌণও হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, সুন্নি গোষ্ঠী হামাসকে শিয়া ইরান সমর্থন করে, যা প্রমাণ করে যে আদর্শগত পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও অভিন্ন শত্রু (ইসরায়েল) মোকাবেলায় জোট সম্ভব ।
৬.৩ বাংলাদেশে শিয়া-সুন্নি সম্প্রীতি ও বিচ্ছিন্ন হামলার বিশ্লেষণ
বাংলাদেশে শিয়া ও সুন্নির মধ্যে বিরোধের কোনো নজির নেই। শতাব্দীকাল ধরে তারা শান্তিপূর্ণভাবে পাশাপাশি বসবাস করে আসছে । বাংলাদেশে শিয়া সম্প্রদায়ের মানুষ খুবই কম, ১৬ কোটি মানুষের দেশে তাদের সংখ্যা আনুমানিক ২২ লাখের মতো ।
তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই সম্প্রীতি নষ্ট করার চেষ্টা করা হয়েছে। ২০১৬ সালের দিকে বগুড়ার একটি শিয়া মসজিদে নামাজরত অবস্থায় গুলিবর্ষণ এবং ঢাকায় তাজিয়া মিছিলে হামলার ঘটনা ঘটেছিল । যদিও এসব হামলার দায় ইসলামিক স্টেট (আইএস) স্বীকার করেছিল, বিশ্লেষকরা এটিকে আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক জড়িত একটি রাজনৈতিক আক্রমণ হিসেবেই দেখেন । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নাজমা বেগমের মতে, “এদেশে শিয়া-সুন্নি সম্প্রদায় গত ৫০০ বছর ধরে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করে আসছে। শিয়াদের উপর এই হামলা রাজনৈতিক, এতে আন্তর্জাতিক কোনো নেটওয়ার্ক জড়িত থাকতে পারে” ।
স্থানীয় সুন্নি অধিবাসীরাও এই নৃশংসতায় দিশাহারা হয়েছে এবং তারা শিয়া ভাইদের রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এই ঘটনা প্রমাণ করে যে, বাংলাদেশে শিয়াদের ওপর হামলা ছিল মূলত একটি ‘আমদানি করা’ সাম্প্রদায়িক সহিংসতা, যা মধ্যপ্রাচ্যের প্রক্সি যুদ্ধের ধর্মীয় ছায়া। দেশের সহজাত সম্প্রীতিই এই ধরনের বহিরাগত উস্কানি মোকাবেলার মূল শক্তি।
৭. উপসংহার ও ভবিষ্যত পর্যবেক্ষণ
সুন্নি ইসলাম বর্তমানে বৈচিত্র্য ও তীব্র চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। একদিকে যেমন সৌদি আরবের ওয়াহাবি মতবাদ থেকে সরে আসা বৈশ্বিক ধর্মীয় অর্থায়ন ও মতাদর্শিক দিকনির্দেশনাকে প্রভাবিত করবে , তেমনি অভ্যন্তরীণভাবে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে দেওবন্দি-বেরেলভি সংঘাতের সমাধান এবং কওমি মাদ্রাসার শিক্ষাব্যবস্থাকে যুগোপযোগী করা জাতীয় স্থিতিশীলতার জন্য অপরিহার্য। কর্মসংস্থানহীন এবং অদক্ষ জনগোষ্ঠী রাজনৈতিক ইসলামের জন্য উর্বর ক্ষেত্র তৈরি করে, যা রাষ্ট্রের জন্য বিপদ ডেকে আনে।
হেফাজতে ইসলামের মতো রাজনৈতিক শক্তিগুলোর চরমপন্থি উত্থান প্রমাণ করে যে, বাংলাদেশে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার একটি প্রধান চ্যালেঞ্জ । আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের সাংবিধানিক মূল্যবোধ ও ধর্মীয় অ্যাক্টিভিজমের মধ্যে একটি স্পষ্ট রেখা টানা জরুরি।
সংঘাত এড়াতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ভূ-রাজনৈতিক শক্তিগুলো কীভাবে শিয়া-সুন্নি বিভেদকে ঔপনিবেশিক কৌশলের মাধ্যমে ব্যবহার করছে, তা উপলব্ধি করা । বাংলাদেশের শতাব্দী প্রাচীন সাম্প্রদায়িক সহাবস্থান রক্ষায় স্থানীয় জনগণ ও রাষ্ট্রকে সচেতন থাকতে হবে। এই প্রেক্ষাপটে, গণমাধ্যমের নিরপেক্ষ এবং সম্প্রীতিমূলক ভূমিকা (যা ম্যগাজিন জনতা নিউজ এবং প্রতিবেদক জে এইচ সুমন-এর আলোচনায় দেখা যায় ) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সংঘাতের পথ পরিহার করে গঠনমূলক আলোচনার পথ প্রশস্ত করাই ভবিষ্যতের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে পারে।
